অলৌকিকতা নয়, হতে পারে ঈমানহানি ! জানুন ইসতিদরাজ কীভাবে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করছে

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বর্তমান যুগে ধর্মের নামে অলৌকিকতার প্রবল বিস্তার এক নতুন বিপদের জন্ম দিচ্ছে। বহু মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের নাম করে এমন কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যেগুলোর সঙ্গে ঈমানের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এধরনের 'অলৌকিকতা' অনেক সময় ইসলামি পরিভাষায় 'ইসতিদরাজ' হিসেবে চিহ্নিত হয় যা মানুষের ধ্বংসের পথ।
'ইসতিদরাজ' কী?
'ইসতিদরাজ' শব্দটি এসেছে আরবি 'দারাজা' (درَج) মূল থেকে, যার অর্থ ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। ইসলামী পরিভাষায় এটি বোঝায়-আল্লাহ তাআলা কোনো ফাসিক, মুনাফিক বা কাফির ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে দুনিয়ার কিছু অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেন, যেন তার দম্ভ বৃদ্ধি পায় ও সে আরও গাফেল হয়ে পড়ে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
"আর যেসব লোক আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করে, আমি ধাপে ধাপে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেই এমনভাবে যে, তারা টেরও পায় না।"
(সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৮২)
সব অলৌকিকতা 'কারামত' নয়!
কারো দ্বারা অলৌকিক কিছু প্রকাশ পেলেই তা 'ওলী' বা 'আল্লাহর বন্ধু' হওয়ার প্রমাণ নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান, তাকওয়া ও সুন্নাহর অনুসরণই ওলীয়াতের মাপকাঠি।
সহিহ মুসলিম হাদিস অনুযায়ী-
"আল্লাহর প্রিয় বান্দা তিনি, যিনি বেশি বেশি ফরজ পালন করেন এবং নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হন।"
(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬৫০২)
ফেরেস্তাতুল হক বনাম ফিরাসাতুল বাতিল-
মোল্লা আলী কারী বলেন, ফিরাসাত বা অন্তর্দৃষ্টির তিন প্রকার:
১. ঈমানি অন্তর্দৃষ্টি-এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত।
২. সাধনার মাধ্যমে অর্জিত অন্তর্দৃষ্টি-যা কাফির-মুমিন উভয়ের হতে পারে।
৩. প্রাকৃতিক অন্তর্দৃষ্টি-চিকিৎসক বা বিশ্লেষকদের বোঝার ক্ষমতা।
এখানে দ্বিতীয় ধরণের ফিরাসাতই বেশি বিভ্রান্তি তৈরি করে। কারণ জিনের সাহায্যে বা নির্জন সাধনার মাধ্যমে হিন্দু সন্ন্যাসী, খ্রিস্টান ফাদার কিংবা তথাকথিত "বাবা-মা"-রাও এমন কিছু করতে পারেন, যা দেখে মানুষ তাদের 'আল্লাহর ওলী' মনে করে ফেলে।
ইসতিদরাজের মাধ্যমে বিভ্রান্তির ইতিহাস:
দাজ্জাল নিজের অলৌকিকতা দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেবে-এটি বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সহিহ মুসলিমে এসেছে, সে আকাশে বৃষ্টি বর্ষণ ঘটাবে, মাটি থেকে ফসল বের করবে।
"সে বলবে, আমি তোমাদের রব, আর মানুষ তাকে বিশ্বাস করবে।" (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৩৭)
আধুনিক যুগের 'পাগলা বাবা' থেকে শুরু করে 'জটাধারি'-সবই কি কারামত?
অনেকেই 'মনের কথা জেনে ফেলা', 'দুআ দিয়ে রোগ নিরাময়', 'আগামী দিনের কথা বলে ফেলা', 'তাবিজে সুস্থতা'-এসবকে ইসলামি কারামত বলে ভুল করছেন। অথচ এগুলোর অধিকাংশই জিন, শয়তান বা অন্য অসৎ মাধ্যম থেকে আসে। কেউ যদি তাকওয়া ও সুন্নাহর অনুসারী না হন, তবে তার যেকোনো অলৌকিক ক্ষমতাই ইসতিদরাজের শামিল হতে পারে।
ইমাম আবু হানিফার সতর্কতা:
কারামতের সংজ্ঞায় ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) স্পষ্ট করে বলেন-
"যে ব্যক্তি শরীয়তের আহকাম মানে না, ফরজ পালন করে না, অথচ তার দ্বারা অলৌকিক কিছু ঘটে-তা ইসতিদরাজ, কারামত নয়।"
সচেতনতা জরুরি:
আজকের দিনে মুমিন-মুসলমানের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো—'কারামত' আর 'ইসতিদরাজ'-এর পার্থক্য জানা। ঈমান রক্ষায় শিরক ও বিদআত থেকে নিজেকে বাঁচানো। কারণ—অন্ধ বিশ্বাসের চেয়ে ভয়াবহ কিছু নেই, যা এক মুসলিমকে নিজের ঈমান থেকেও বিচ্যুত করতে পারে।
ইসলামে অলৌকিকতার চাইতে বড় প্রমাণ হল ঈমান, তাকওয়া এবং রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহর অনুসরণ। তাই কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা তথাকথিত 'ওলী-বাবা'-র অলৌকিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ার আগে, একবার নিজেই বিচার করুন—এই কাজ কি সত্যিই শরিয়তের আলোকে বৈধ?
পরামর্শ:
যেকোনো চমকপ্রদ 'দোয়াবাজি' বা অলৌকিকতা দেখে ঈমানী অবস্থান হারাবেন না। ইসলাম চায় সজাগ হৃদয়, পরিশুদ্ধ চেতনা ও সহীহ আকিদা। অলৌকিকতার মোহ নয়, সত্য ও সুন্নাহর পথে ফিরে আসুন। আল্লাহ হেদায়াত দিন।
সূত্র: কুরআন, সহিহ হাদিস, শারহুল ফিকহুল আকবর – মোল্লা আলী কারী, ইসলামী চিন্তাবিদদের বর্ণনা
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।