চোখের সামনেই সত্য আর মিথ্যার ফাটল-ডিপফেইক প্রযুক্তির ভয়াবহ প্রভাব ও তার প্রতিরোধের পথ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বর্তমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিংয়ের অগ্রগতির কারণে 'ডিপফেইক' (Deepfake) প্রযুক্তি বিপ্লবী হলেও ভয়াবহ বিপদও বয়ে এনেছে। ডিপফেইক শব্দের অর্থ হলো 'গভীর নকল', যেখানে কোনো ব্যক্তির মুখমণ্ডল, ভাষণ বা অঙ্গভঙ্গিকে এআই ব্যবহার করে সিমুলেট বা জাল ভিডিও বানানো হয়। এই ভিডিওগুলো এতটাই প্রাকৃতিক এবং বাস্তবসম্মত যে গড়ে তুলতে বছরখানেক সময় লাগতেও পারে, আর এখন মাত্র কয়েক মিনিটেই তৈরি হয়।
ডিপফেইকের প্রযুক্তিগত ভিত্তি:
⇨ GAN (Generative Adversarial Networks) , ডিপফেইক তৈরির মূল প্রযুক্তি। দুটি নিউরাল নেটওয়ার্ক পরস্পরের বিপরীতে কাজ করে—একটি ছবি বা ভিডিও তৈরি করে, অন্যটি সেটি সত্য কিনা যাচাই করে।
⇨ ডিপ লার্নিং মডেল: প্রচুর পরিমাণে ভিডিও ও ছবি থেকে শিক্ষণ নিয়ে মুখের এক্সপ্রেশন ও ভাষণ মিলিয়ে নেয়।
⇨ রিয়েলটাইম সিন্থেসিস: এখন ডিপফেইক ভিডিও সরাসরি লাইভেও তৈরি করা সম্ভব।
ডিপফেইকের ব্যবহার ও ভয়াবহতা:
১. রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও প্রোপাগান্ডা:
ডিপফেইক ভিডিও ব্যবহারে নেতাদের মিথ্যা বক্তব্য তৈরির মাধ্যমে জনমত বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমন একটি ভিডিও নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়।
২. ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকি:
নকল ভিডিও বানিয়ে কোনো ব্যক্তির সম্মানহানি, মানহানি, এবং 'র্যাপ' বা হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি। বিশেষ করে নারী ও পাবলিক ফিগারের বিরুদ্ধে দমনমূলক ও অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ায় গুরুতর সমস্যা।
৩. অর্থনৈতিক প্রতারণা:
ডিপফেইক ব্যবহার করে ব্যাংকিং বা ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণা, পরিচয় চুরি এবং চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. সামাজিক ও ধর্মীয় সংঘাত:
মিথ্যা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন ও হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
ডিপফেইকের চিন্তার মূল কারণসমূহ:
⇨ প্রামাণ্যতা যাচাইয়ের সংকট:
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে ডিপফেইক ভিডিও সত্যের সঙ্গে খুব মিল থাকে, ফলে সনাক্ত করা খুব কঠিন।
⇨ আইনগত ব্যবস্থা দেরিতে:
অনেক দেশে এখনো ডিপফেইক সম্পর্কিত স্পষ্ট আইন ও দণ্ড বিধান নেই বা তা খুবই সীমিত।
⇨ সামাজিক সচেতনতার অভাব:
বেশির ভাগ মানুষ এখনও ডিপফেইক সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে, যা বিভ্রান্তি ও অপব্যবহারের সুযোগ বাড়ায়।
যেভাবে সনাক্ত করবেন ডিপফেইক?
⇨ মুখের অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি বা চােলাচল যা স্বাভাবিক নয়।
⇨ কথাবার্তার সঙ্গে মুখের গতি মিল না খাওয়া।
⇨ চোখের অস্বাভাবিক চকমকি বা অস্বাভাবিক ছায়া।
⇨ ভিডিওর লাইটিং ও কালারের অস্বাভাবিকতা।
⇨ সোর্স বা প্রকাশক সংস্থার বিশ্বস্ততা যাচাই।
প্রযুক্তিগত ও সামাজিক প্রতিরোধের উপায়:
১. ডিপফেইক সনাক্তকরণ সফটওয়্যার:
গুগল, মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান উন্নত এআই ভিত্তিক টুল বানিয়েছে, যা ভিডিও বিশ্লেষণ করে মিথ্যা শনাক্ত করে।
২. আইনি বিধিমালা:
বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে ডিপফেইক ভিডিও তৈরি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন শুরু করেছে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার কিছু রাজ্যে।
৩. সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি:
সামাজিক মাধ্যমে, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া লিটারেসি এবং ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো।
৪. ব্যক্তিগত সতর্কতা:
অজানা সোর্স থেকে পাওয়া ভিডিও বিশ্বাস না করা, তথ্য যাচাই করা, এবং সন্দেহজনক ভিডিও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা।
ডিপফেইক প্রযুক্তি আমাদের চোখে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের রেখা মুছে দিয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন থামানো যাবে না, তবে এর অপব্যবহার রোধের জন্য আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থে আমাদের সবার উচিত ডিজিটাল মিডিয়াকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করা এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে সজাগ থাকা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।