নিজেকে মৃত মনে করা মানসিক রোগ-সত্যিই কি এমন কিছু সম্ভব? জানুন কোটার্ড সিনড্রোমের ভেতরের ভয়াবহতা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
নিজেকে মৃত ভাবা কি সম্ভব? শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, এটি একটি বাস্তব ও প্রমাণিত মানসিক ব্যাধি। যার নাম Cotard's Delusion বা Cotard's Syndrome। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকেই মৃত, অস্তিত্বহীন বা পচনশীল বলে বিশ্বাস করে। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই অবস্থা যেন 'Walking Corpse Syndrome'-শুধু শরীর আছে, অথচ আত্মবিশ্বাস, পরিচয়, এমনকি জীবনের অনুভবও নিঃশেষ!
এই মানসিক অবস্থার প্রথম বর্ণনা দেন ফরাসি স্নায়ুবিজ্ঞানী জুলেস কোটার্ড (Jules Cotard), ১৮৮০ সালে। তিনি তার এক রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষ করেছিলেন, ওই মহিলা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন, বিশ্বাস করছিলেন তার শরীরে রক্ত নেই, আত্মা চলে গেছে, এমনকি পাপের কারণে তিনি চিরশাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন।
স্নায়ুবিজ্ঞান ও কোটার্ড'স সিনড্রোম - মস্তিষ্কের যে অংশ জড়িত
এটি কেবল মনগড়া নয়-মস্তিষ্কের ফাংশনাল ডিসকানেক্ট এর ফল। বিভিন্ন নিউরোইমেজিং (যেমন fMRI ও PET Scan)-এ দেখা গেছে:
⇨ Parietal Lobe ও Frontal Lobe-এর সংযোগে ঘাটতি তৈরি হয়।
⇨ Temporoparietal Junction (TPJ) ও Limbic System-এর মধ্যে তথ্য বিনিময় বিঘ্নিত হয়।
⇨ এতে আত্মচেতনা (self-awareness) ও আবেগগত মূল্যায়ন দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই অস্বাভাবিক সংযোগের কারণে, মস্তিষ্কের "আমি বেঁচে আছি" অনুভূতিটি দুর্বল হয়ে যায় বা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।
রোগীর মানসিক উপসর্গসমূহ কী রকম?
রোগীরা সাধারণত বলে থাকেন:
"আমি মারা গেছি"। "আমার হৃদয় বা পাকস্থলী কাজ করছে না"। "আমার শরীর গলে যাচ্ছে"। "আমি চিরতরে অভিশপ্ত, মৃত্যুও আমাকে গ্রহণ করছে না"। কেউ কেউ আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেন, যেন 'মৃত' অবস্থাটিকে বাস্তব প্রমাণ করা যায়। এটি Depersonalization ও Nihilistic Delusion এর চরম রূপ।
রোগটি কীভাবে তৈরি হয়?
এই সিনড্রোম সাধারণত নিম্নোক্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেখা যায়:
⇨ Major Depressive Disorder (MDD)
⇨ Psychotic Depression
⇨ Schizophrenia
⇨ Neurological Damage (যেমন স্ট্রোক, ব্রেন টিউমার, ট্রমা)
⇨ ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝেইমার রোগে
⇨ আক্রান্তদের মধ্যেও কোটার্ড-জাতীয় উপসর্গ দেখা যায়।
কোটার্ড'স সিনড্রোমের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—আত্মহত্যা বা আত্মনাশের প্রবণতা। রোগী যখন নিজেকে মৃত মনে করেন, তখন তার জীবনের কোনো মূল্যবোধ বা রক্ষাকবচ থাকে না। তাই এমন রোগীদের অবস্থা অবিলম্বে মূল্যায়ন করা জরুরি।
চিকিৎসা:
➤ ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা:
◑ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (SSRIs, TCAs)
◑ অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগস (Risperidone, Olanzapine)
◑ Mood stabilizers (Lithium)
◑ কিছু ক্ষেত্রে Electroconvulsive Therapy (ECT) অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
➤ মনোবিশ্লেষণ ও থেরাপি:
◑ Cognitive Behavioral Therapy (CBT)
◑ Reality orientation techniques
◑ Family-based psychoeducation
-রোগীকে তার ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হয়।
বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ নয়, বিরল-তবুও ভয়াবহ
Cotard's Syndrome একটি বিরল ডিসঅর্ডার-বিশ্বে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা মাত্র কয়েকশ। তবে এর ভয়াবহতা এতটাই যে চিকিৎসা না পেলে জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, "এই রোগে শরীর নয়, অস্তিত্বটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে।"
কোটার্ড'স সিনড্রোম কেবল একটি মানসিক সমস্যা নয়, এটি অস্তিত্বের সংকট। মানুষ যখন নিজেকে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে এবং মৃত বলে বিশ্বাস করে, তখন সমাজ, পরিবার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
সতর্কতা: মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা নয়-এটি সময়মতো বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্র।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।