রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ: পাঁচ মহারথীর অমর কীর্তি

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে রাশিয়ার নাম উঠলেই এক স্বর্ণালি যুগের কথা ভেসে ওঠে-উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শেষভাগ পর্যন্ত সময়টিকে সাহিত্য সমালোচকরা বলেন "রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ"। সেই সময়ে জন্ম নেয় একের পর এক অসামান্য সাহিত্যিক, যাদের কলম বদলে দিয়েছিল রাশিয়ার সাহিত্যভূমি, আর সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত। শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, তাদের রচনা রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সমাজবিজ্ঞানেও রেখে গেছে স্থায়ী ছাপ।
এ যুগের অসংখ্য নামের মধ্যে পাঁচজনের অবদান এতটাই গভীর যে, তাদের বাদ দিয়ে রুশ সাহিত্য কল্পনাই করা যায় না—আলেকজান্ডার পুশকিন, নিকোলাই গোগোল, ফিওদর দস্তয়োভস্কি, লিও তলস্তয় ও আন্তন চেখভ।
১. আলেকজান্ডার পুশকিন : ১৭৯৯ সালে জন্ম নেয়া পুশকিনকে বলা হয় "আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক"। রোমান্টিক কবিতা, নাটক, ছোটগল্প থেকে উপন্যাস-সব ধারাতেই তার সমান দখল। বিখ্যাত রচনা 'দ্য ব্রোঞ্জ হর্সম্যান', 'বোরিস গোদুনোভ', আর কাব্য-উপন্যাস 'ইয়েভেজেনি ওনেজিন' আজও বিশ্বজুড়ে অধ্যয়নের বিষয়।
কান্ট ও ভলতেয়ারের উদারনৈতিক দর্শনের প্রভাবে তিনি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন সাহসিকতার সাথে। বিপ্লবী কবিতার জন্য বারবার সরকারি রোষের শিকার হন, নির্বাসনেও কাটাতে হয়েছে বছর কয়েক।
ব্যক্তিত্বে ছিলেন একগুঁয়ে ও তীব্র-জীবনে বহুবার ডুয়েল লড়েছেন। ১৮৩৭ সালে এক ডুয়েলে আহত হয়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বিদায় নিলেও, ততদিনে রুশ সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এক নতুন উচ্চতায়।
২. নিকোলাই গোগোল:
১৮০৯ সালে ইউক্রেনের এক সাহিত্যমনা পরিবারে জন্ম নেন গোগোল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিক্রি না হওয়ায় নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেলার পরও লেখালেখি থামাননি। ইউরোপ, সোভিয়েত অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন, মিশেছেন দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে।
তার রচনায় বাস্তবতার সাথে ব্যঙ্গের অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। 'দ্য ওভারকোট' ও 'ডেড সোলস' তাকে আধুনিক রুশ উপন্যাসের পথিকৃৎ বানিয়েছে।
বন্ধু পুশকিনের মৃত্যুতে গভীরভাবে ভেঙে পড়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। শেষ জীবনে পাপের ভয়ে নিজের লেখা দ্বিতীয় খণ্ড 'ডেড সোলস' পুড়িয়ে ফেলেন এবং স্বেচ্ছায় আহার ত্যাগ করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।
৩. ফিওদর দস্তয়োভস্কি : ১৮২১ সালে মস্কোয় জন্ম নেয়া দস্তয়োভস্কি জারের শাসনে প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন, পরে ক্ষমা পেয়ে নির্বাসনে যান সাইবেরিয়ায়।
তার উপন্যাস 'ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট', 'দ্য ইডিয়ট', 'দ্য ডেমনস', এবং 'দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ' মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা ও "স্ট্রিম অব কনশাসনেস" কৌশলের জন্য বিখ্যাত।
জেমস জয়েস, কাফকা, নিৎসে থেকে আইনস্টাইন-অগণিত সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদকে প্রভাবিত করেছেন তিনি। জুয়ার আসক্তি, মৃগীরোগ, ব্যক্তিগত সংকটের মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রত্নগুলো। ১৮৮১ সালে মৃত্যুর আগে শেষ করেন 'দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ', যা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন স্ত্রী আনাকে।
৪. লিও তলস্তয় : ১৮২৮ সালে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া তলস্তয় আজও বিশ্বসাহিত্যের শীর্ষে। 'ওয়ার এন্ড পিস' ও 'আন্না কারেনিনা' শুধু রাশিয়া নয়, গোটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
অসংখ্য ভাষা শিখে মূল ভাষায় বই পড়ার বিরল অভ্যাস ছিল তার। জীবনের পথে জমিদারি ব্যর্থতা, সৈনিক জীবন, দার্শনিক চর্চা-সবই মিশেছে তার রচনায়। অহিংস দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীও।
জীবনের শেষ দিকে সব সম্পদ ত্যাগ করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৮২ বছর বয়সে এক স্টেশনে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. আন্তন চেখভ : ১৮৬০ সালে জন্ম নেয়া চেখভ ছিলেন চিকিৎসক, কিন্তু মূল পরিচয় নাট্যকার ও গল্পকার। জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন মানুষের সেবা করে-হাসপাতাল নির্মাণ, রোগীর চিকিৎসা, এমনকি কলেরা আক্রান্ত অঞ্চলে কাজ করে।
অর্থের প্রয়োজনে লেখা শুরু করলেও, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার। 'দ্য সিগাল', 'থ্রি সিস্টার্স', 'দ্য চেরি অরচার্ড' তার বিখ্যাত নাটক, আর 'দ্য লেডি উইথ দ্য ডগ', 'দ্য ক্যামেলিওন' প্রভৃতি গল্প রয়ে গেছে চিরসবুজ।
যক্ষ্মার সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯০৪ সালে শ্যাম্পেনের এক চুমুকের পর বিদায় নেন সাহিত্যাঙ্গন থেকে-ফেলে যান অমর উত্তরাধিকার।
এই পাঁচ নক্ষত্রের আলোয় রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ আজও উজ্জ্বল। তাদের কলমের আঁচড়ে জন্ম নিয়েছে এমনসব চরিত্র ও কাহিনি, যা কেবল রাশিয়ার নয়-সমগ্র মানবসভ্যতার সাংস্কৃতিক সম্পদ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।