কেন সব দেশের মুদ্রা ছাপা হয় না স্বর্ণ দিয়ে? জানুন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির লুকানো রহস্য

কেন সব দেশের মুদ্রা ছাপা হয় না স্বর্ণ দিয়ে? জানুন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির লুকানো রহস্য
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমরা প্রায়ই ভাবি যদি টাকা সত্যিই স্বর্ণ দিয়ে ছাপা হতো, তাহলে তো মুদ্রাস্ফীতি বা দামের উর্ধ্বগতি হতো না! কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আজকের আধুনিক অর্থনীতি কেবল স্বর্ণের ওপর নির্ভর করলে ধসে পড়ত। কেননা এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, জটিল গণিত, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবাহ।

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের জন্ম ও শক্তি- 

১৮২১ সালে প্রথম যুক্তরাজ্য স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রা চালু করে, পরে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলো অনুসরণ করে। প্রতিটি নোট বা কয়েনের পেছনে ভল্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ থাকত।
ফলে মুদ্রা জাল হতো না, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হতো, কারণ সবাই জানত ১ ডলার মানে ঠিক কত গ্রাম স্বর্ণ।

 

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড যেকারণে  ভেঙে পড়ল-

⇨ বিশ্বযুদ্ধ ও খরচ: প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশগুলো বিপুল অর্থ খরচ করে। যুদ্ধ শেষে তারা স্বর্ণ রিজার্ভ দিয়ে সেই অর্থ মেলাতে পারেনি।

⇨ অর্থনীতির আকার: শিল্প বিপ্লব, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির গতি এত দ্রুত বাড়ল যে, স্বর্ণের মজুত আর মুদ্রার চাহিদার সঙ্গে মিলল না।

⇨ সংকটকালে সীমাবদ্ধতা: অর্থনৈতিক মন্দা বা মহামন্দার সময়ে (১৯৩০) দেশগুলো অতিরিক্ত টাকা ছাপতে চাইত, কিন্তু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড তাদের তা করতে দেয়নি।

⇨ আমেরিকার সিদ্ধান্ত: ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ডলারের স্বর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এটিই "Nixon Shock" নামে পরিচিত। এর পর থেকে ডলার সম্পূর্ণভাবে ফিয়াট মানি হয়ে যায়।
 

আজকের দিনে টাকা হলো "ফিয়াট কারেন্সি"

এর মান নির্ধারণ করে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বৈশ্বিক বাজার ও মানুষের আস্থা।
কাগজ বা ডিজিটাল মুদ্রার পেছনে আসলে কোনো ধাতব সমর্থন নেই, তবে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয় যে এই নোট বৈধ লেনদেনের মাধ্যম।
 

মূল সূত্র: "টাকার মান নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির শক্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক চাহিদার ওপর।"
 

কেন আবার স্বর্ণভিত্তিক অর্থনীতি সম্ভব নয়?

১. স্বর্ণ সীমিত: পৃথিবীতে মোট স্বর্ণের পরিমাণ সীমিত, কিন্তু অর্থনীতির আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

২. প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতি: ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডিজিটাল টাকা, ই-কমার্স—সব মিলিয়ে কেবল স্বর্ণ দিয়ে চাহিদা মেটানো অসম্ভব।

৩. অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা: আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার পরিবর্তন বা টাকা ছাপিয়ে মন্দা সামলায়। স্বর্ণভিত্তিক হলে এটি সম্ভব হতো না।

৪. আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা: যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন তাদের অর্থনীতি এত বড় যে, সীমিত স্বর্ণ দিয়ে তারা চলতে পারত না।

 

তবে স্বর্ণের গুরুত্ব কোথায় রইল!!

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আজও স্বর্ণকে রিজার্ভ হিসেবে রাখে।ডলার বা ইউরোর মান কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ করে নিরাপত্তা খোঁজেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও অল্প হলেও বৈদেশিক রিজার্ভের অংশ হিসেবে স্বর্ণ ধরে রাখে।
 

বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রভাব-

বাংলাদেশি টাকার মান নির্ধারণ হয় মূলত ডলারের বিপরীতে।আমাদের আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক রিজার্ভ ও প্রবাসী আয়ের ওঠানামা টাকার শক্তি বা দুর্বলতা তৈরি করে। ফলে টাকা এখন শুধু মুদ্রা নয়, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক আস্থার প্রতিফলন।


টাকা ছাপার যুগ আজ আর কেবল ধাতু নির্ভর নয়। স্বর্ণভিত্তিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হলেও সীমিত সম্পদের কারণে তা আধুনিক অর্থনীতির জন্য অপ্রযোজ্য। আজকের মুদ্রা আসলে হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক আস্থার প্রতীক।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ