হত্যার ন্যায়বিচার ও মানবিক শিক্ষা-ইসলামে ক্বিসাসের সত্যিকারের উদ্দেশ্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ইসলামে অবৈধভাবে কাউকে হত্যার শাস্তি কেবল শাস্তিমূলক নয়, বরং মানবিক ও ন্যায়সংগত নিয়মাবলীও বহন করে। ক্বিসাস অর্থাৎ হত্যার বদলে হত্যার বিধান বা দিয়াত (ক্ষতিপূরণ) মানুষের জীবন ও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে ক্বিসাস বাস্তবায়নের জন্য হত্যাকৃত ব্যক্তির পরিবার বা ওয়ারিশদের সম্মতি অপরিহার্য।
ক্বিসাস ও দিয়াত হলো ন্যায় ও ক্ষমার ভারসাম্য।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস্ তথা হত্যার পরিবর্তে হত্যা নির্ধারণ করা হলো। তবে যদি নিহতের পরিবার ক্ষমা করে বা ক্বিসাসের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ (দিয়াত) গ্রহণ করতে চায়, তা ন্যায়সঙ্গতভাবে আদায় করতে হবে। এরপরও কেউ সীমালঙ্ঘন করলে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।"
-(বাক্বারাহ : ১৭৮)
আয়াতটির প্রেক্ষাপট:
ইসলামে হত্যার শাস্তি প্রযোজ্য হলেও নিহতের পরিবারকে ক্ষমা করার বিকল্প দেওয়া হয়েছে। এটি মানবিক ন্যায়ের প্রকাশ, যাতে পরিবার ও সমাজ দু'ই শান্ত থাকে। সমাজে উদার নৈতিকতা প্রচার এবং ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে পরিবারকে মানসিক শোক মোকাবিলার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ক্বিসাসে মানবিক শিক্ষা নিয়ে হাদিসে এসেছে,
"কেউ কাউকে হত্যা করলে তার ওয়ারিশদের দু'টি অধিকার থাকবে—ক্বিসাস নেয়া বা দিয়াত গ্রহণ করা। তারা যেন বিবেচনা করে উত্তমটিই গ্রহণ করে।"-(বুখারী ১১২; মুসলিম ১৩৫৫; আবূ দাউদ ৪৫০৫; তিরমিযী ১৪০৬)
অর্থাৎ, ওয়ারিশদের হাতে দুটি বিকল্প থাকা মানে বিচার প্রক্রিয়ায় পরিবারকে ক্ষমা বা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। এটি হত্যাকৃতের পরিবারকে মানসিক শান্তি দেয়, পাশাপাশি সামাজিক সহনশীলতা বাড়ায়।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে - "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বিসাস সংক্রান্ত কোনো মামলা উপস্থাপন হলে সর্বপ্রথম ক্ষমার পরামর্শ দিতেন।" -(আবূ দাউদ ৪৪৯৭; ইব্নু মাজাহ ২৭৪২)
এই হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, বিচারক প্রথমে ক্ষমার পরামর্শ দেবেন। এটি দেখায়, ইসলামে দোষীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষমারও গুরুত্ব রয়েছে। ক্ষমা প্রস্তাব দিয়ে সমাজে শান্তি ও ন্যায় নিশ্চিত করা হয়।
সরাসরি হত্যা ও তুলনামূলক হত্যার ক্ষেত্রে,
যদি কেউ অপ্রচলিত বা অদ্ভুত কোনো বস্ত্র/উপকরণ দিয়ে অপরাধ করে, যেখানে সাধারণত হত্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, তখন সেটিকে "তুলনামূলক ইচ্ছাকৃত হত্যা" ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে ক্বিসাস নয়, দিয়াত আদায় করা হয়।
এটি দেখায়, ইসলাম শুধু শাস্তি নয়, ন্যায়পরায়ণ বিচারও নিশ্চিত করে। ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে অপরাধের দায়িত্বও নির্দিষ্ট করা হয়।
কোনো মুসলিমকে কাফিরের পরিবর্তে হত্যা করা যাবে না। হাদিসে এসেছে -
"কোন মুসলিমকে কাফিরের পরিবর্তে হত্যা করা যাবে না। বরং হত্যার পরিবর্তে দিয়াত প্রদান করতে হবে।"
-(বুখারী ১১১; আবূ দাউদ ৪৫৩০; তিরমিযী ১৪১২)
ইসলাম ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ নৈতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে। ভুল লক্ষ্যবস্তু বা অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া কখনো অনুমোদিত নয়।
হত্যাকারী ও সম্পত্তির বেপারে হাদিসে এসেছে,
"হত্যাকারী ব্যক্তি কোনো মিরাস বা সম্পত্তি পাবে না।" -(ইব্নু মাজাহ ২৬৯৫)
অর্থাৎ, হত্যাকারীর উপার্জন বা সম্পত্তি কখনো হত্যাকৃতের পরিবারে যাবে না। এটি নিশ্চিত করে ন্যায়পরায়ণতা এবং হত্যা থেকে উৎসাহিত হবার সুযোগ কমায়।
ক্বিসাস মুলত জীবন সংরক্ষণ ও সতর্কতার শিক্ষা দেয়। ক্বিসাস শুধু শাস্তি নয়, এটি অপরাধ প্রতিরোধ ও নতুন জীবন রক্ষার মাধ্যম। মানুষ হত্যার ঝুঁকি কমানোর জন্য সতর্ক থাকে, সমাজে শান্তি বজায় থাকে।
এবেপারে কোরআন মাজিদে আছে,
"হে জ্ঞানী লোকেরা! ক্বিসাসের মধ্যেই তোমাদের সকলের বাস্তব জীবন লুক্কায়িত আছে। এতে হয়তো আল্লাহভীরু হবে।" -(বাক্বারাহ : ১৭৯)
অন্য একটি হাদিসে রয়েছে -
"যে ব্যক্তি ক্বিসাস বা দিয়াত বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে, তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সকল মানুষের লা'নত।" -(আবূ দাউদ ৪৫৪০, ৪৫৯১; নাসায়ী ৮/৩৯; ইব্নু মাজাহ ২৬৮৫)
অর্থাৎ, আইন কার্যকর করতে বাধা দেয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা বিঘ্নিত হয়।
ইসলামে কেবল দোষীকে শাস্তি দেওয়া হয়, অন্য কাউকে নয়। এটি ন্যায়পরায়ণতার স্পষ্ট উদাহরণ।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-একজন ইহুদি ব্যক্তি দু'টি পাথরের মাঝে একটি আন্সারী মেয়ের মাথা পিষে দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যাকারীকে যথাযথভাবে দণ্ডিত করার নির্দেশ দেন। -(বুখারী ২৪১৩; মুসলিম ১৬৭২)
ইসলামী ক্বিসাস শুধুমাত্র শাস্তিমূলক নয়; এটি মানবিক শিক্ষা, ন্যায়বিচার, সতর্কতা ও আত্ম-সংযমের শিক্ষা দেয়। ক্বিসাস হলো প্রতিটি জীবনের মর্যাদা রক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইসলামী উদ্যোগ, যা আজকের যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।