গাইডেন্স না কি বাণিজ্য?—শিক্ষাব্যবস্থার অজানা সত্য ফাঁস হচ্ছে!

গাইডেন্স না কি বাণিজ্য?—শিক্ষাব্যবস্থার অজানা সত্য ফাঁস হচ্ছে!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে প্রাইভেট গাইডেন্স বা কোচিং নির্ভর শিক্ষা আজ একটি সাধারণ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসরুমের শিক্ষা যেন ক্রমে "আনুষ্ঠানিকতা" হয়ে যাচ্ছে, আর আসল শিক্ষার ক্ষেত্র গড়ে উঠছে শ্রেণিকক্ষের বাইরে—প্রাইভেট টিউশন, গাইডেন্স সেন্টার বা বড় বড় কোচিং প্রতিষ্ঠানে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য—জ্ঞানার্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও চিন্তাশক্তি গড়ে তোলা—তার জায়গায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কেবল ভালো নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতা।

কেন শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট গাইডেন্সে ঝুঁকছে?

১. শ্রেণিকক্ষে সীমিত মনোযোগ – একেকটি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে প্রত্যেককে আলাদা করে বোঝানো বা দুর্বল শিক্ষার্থীর পাশে সময় দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
 

২. পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা – পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই শিক্ষার প্রধান মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই লক্ষ্য "ফলাফল", "জ্ঞান নয়"।
 

৩. ভর্তি পরীক্ষার চাপ – মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতা এতটাই কঠিন যে, শিক্ষার্থীরা মনে করে "কোচিং ছাড়া ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়"।
 

৪. অভ্যাসগত নির্ভরতা – অনেক শিক্ষার্থী শৈশব থেকেই টিউশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে আত্মশিক্ষার অভ্যাস তৈরি হয় না।



শিক্ষার্থীর উপর প্রভাব:

প্রাইভেট গাইডেন্স নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের দুর্বল জায়গাগুলো পূরণে সাহায্য করে। তবে এর ক্ষতিকর দিকও কম নয়—

অনেক শিক্ষার্থী মূল পাঠে মনোযোগ দেয় না, কারণ তারা জানে টিউশনে আবার পড়ানো হবে।


সৃজনশীল ও অনুসন্ধানী চিন্তার জায়গায় তারা মুখস্থ নির্ভর হয়ে ওঠে।

শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য—চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি—গৌণ হয়ে যাচ্ছে।



অভিভাবকের আর্থিক ও মানসিক চাপ:

প্রাইভেট গাইডেন্স এখন অনেক পরিবারের জন্য "অপরিহার্য ব্যয়"।

শহরে একেকজন শিক্ষার্থীর টিউশন খরচ মাসে কয়েক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ভর্তি পরীক্ষার সময় কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

গ্রাম বা প্রান্তিক অঞ্চলের পরিবারগুলো এই ব্যয় বহন করতে না পারায় পিছিয়ে পড়ে, ফলে শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে।
একইসঙ্গে অভিভাবকদের মানসিক চাপও বেড়ে যায়—সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য "বাধ্য হয়ে" খরচ চালাতে হয়।


অনেক শিক্ষক মূল ক্লাসে পুরোপুরি পড়ান না, বরং শিক্ষার্থীদের ইঙ্গিত দেন যে "গাইডেন্সে এলে ভালোভাবে শেখানো হবে"। এতে শিক্ষকরা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান, কিন্তু শিক্ষার নৈতিক মান ক্ষুণ্ণ হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের ভূমিকা ধীরে ধীরে "আধা-সময়ের শিক্ষক" হয়ে যাচ্ছে, আর আসল শিক্ষার জায়গা হয়ে উঠছে প্রাইভেট সেশন।


রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে কোচিং সেন্টার এখন এক বিশাল ব্যবসা। বিশেষায়িত ভর্তি কোচিং, ইংরেজি-ম্যাথ গাইডেন্স, এমনকি শিশু শ্রেণির জন্যও আলাদা কোচিংয়ের বাজার গড়ে উঠেছে। একদিকে এতে কর্মসংস্থান তৈরি হলেও, অন্যদিকে শিক্ষাকে ব্যবসার হাতিয়ার বানানোয় শিক্ষার মূল মানসিকতা দুর্বল হচ্ছে।



দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:

১. শিক্ষায় বৈষম্য – নিম্ন আয়ের পরিবার এ সুযোগ নিতে না পারায় তাদের সন্তান পিছিয়ে পড়ছে।

২. সৃজনশীলতা হ্রাস – শিক্ষার্থীরা আত্মশিক্ষার বদলে বাইরের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে।

৩. শিক্ষা ব্যবসায় রূপান্তর – শিক্ষা হয়ে উঠছে লাভজনক বাজার, যেখানে মান ও নৈতিকতা গৌণ।
৪. মানসিক চাপ বৃদ্ধি – শিক্ষার্থীর প্রতিটি মুহূর্ত ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কাটছে, ফলে মানসিক স্বস্তি ও শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে।



 মূলকথা হলো—প্রাইভেট গাইডেন্স শিক্ষার্থীর জন্য আংশিক সহায়ক হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব শিক্ষার মান, সমতা এবং শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার ওপর নেতিবাচক ছাপ ফেলছে। লাভবান হচ্ছে কোচিং ব্যবসা ও কিছু শিক্ষক, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য ক্রমশ আড়াল হয়ে যাচ্ছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ