ক্যালিফোর্নিয়ার গোপন জঙ্গলে লুকানো দৈত্য সেকুইয়া-রহস্য উন্মোচিত!

ক্যালিফোর্নিয়ার গোপন জঙ্গলে লুকানো দৈত্য সেকুইয়া-রহস্য উন্মোচিত!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাকৃতিক বিস্ময় আছে, যা মানুষকে নীরবে স্তব্ধ করে দেয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সেকুইয়া বন সেই বিস্ময়েরই একটি। উচ্চতা, আকার, ওজন এবং বয়স-সব দিক থেকেই এই গাছ যেন প্রকৃতির এক মহাকাব্য। বিজ্ঞানীরা একে বলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ জীবন্ত সত্তা।

সিয়েরা নেভাদার ঢালে সেকুইয়া

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পশ্চিম ঢালে বিস্তৃত Sequoia National Park এবং Yosemite National Park—এই দুই অভয়ারণ্যই সেকুইয়ার নিবাস। পার্ক দুটিতে হাজার হাজার সেকুইয়া দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এখানে থাকা অনেক গাছের বয়স ২,৫০০ বছরেরও বেশি। অর্থাৎ যখন মানুষ এখনো প্রাচীন সভ্যতার সময় পার করছিল, তখনই এই গাছগুলো নবীন কিশোর ছিল।

আকারে অদ্বিতীয়:

উচ্চতা: গড়ে ২৫০ ফুট (প্রায় ২৫ তলা ভবনের সমান)

ওজন: প্রায় ১,৩০০ মেট্রিক টন (৩০০ হাতির সমান)

গুঁড়ির পরিধি: ১০০ ফুট পর্যন্ত

বাকলের পুরুত্ব: প্রায় ৩ ফুট

গড় আয়ু: প্রায় ৩,০০০ বছর
 

অন্যদিকে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী Coastal Redwood গাছগুলো লম্বায় সেকুইয়ার চেয়েও উঁচু (৩৫০ ফুটের বেশি), কিন্তু আয়তন ও ওজনে তারা সেকুইয়ার কাছে শিশুর মতোই ছোট।
 

আগুন-যেখানে মৃত্যু নয়, বরং জন্ম

অন্য বৃক্ষের জন্য অরণ্যদাহ মানে ধ্বংস, কিন্তু সেকুইয়ার জন্য এটি নতুন জীবনের সূচনা। আগুনের প্রচণ্ড তাপে গাছের শঙ্কু আকৃতির খোল শুকিয়ে ফেটে যায়, আর ভেতরে থাকা ক্ষুদ্র বীজ ঝরে পড়ে মাটিতে। সেই বীজ পরে আগুনে পোড়া পাতার স্তূপে অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে নতুন সেকুইয়া। প্রকৃতির এই অদ্ভুত সমীকরণ না থাকলে হয়তো আজ পৃথিবীতে এত সেকুইয়া থাকতই না।
 

প্রকৃতির সহায়ক প্রাণী- 

বনের কাঠবিড়ালিরাও সেকুইয়ার বংশবিস্তার প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। তারা সেকুইয়ার খোল খেয়ে ফেলার সময় ভেতরের বীজ মাটিতে পড়ে যায়। ফলে নতুন গাছ জন্ম নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
 

কেন এত দীর্ঘজীবী?

সেকুইয়ার বাকল ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত পুরু এবং এর মধ্যে বিশেষ রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আগুন লাগলেও এই ছাল সহজে পুড়ে যায় না। এজন্যই শত শত বছর আগের সেকুইয়া গুঁড়িও আজ অবিকৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
 

দৈত্যের দুর্বলতা- 

এত শক্তিশালী হয়েও সেকুইয়ার মৃত্যু ঘটে মূলত নিজের ওজনের কারণেই। শিকড়গুলো লম্বালম্বি ছড়িয়ে পড়ে বটে, তবে গভীরে যায় না। তাই প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা ঝোড়ো হাওয়ায় বিশাল দেহের ভার ধরে রাখতে না পেরে মাটিসহ উপড়ে পড়ে যায়। ১৯৭০ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটে—একটি বিশাল সেকুইয়া পড়ে গিয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। গাছটি সরানো অসম্ভব হয়ে পড়ায়, কাণ্ড কেটে তাতে সুরঙ্গ তৈরি করা হয়। আজও পর্যটকরা গাড়ি চালিয়ে সেই সুরঙ্গ দিয়ে যায়।
 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাছ: General ষেরমান-

সব সেকুইয়ার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও বৃহৎ গাছ হলো General Sherman।

উচ্চতা: ২৭৫ ফুট

কাঠের আয়তন: ৫২,০০০ ঘনফুট

ওজন: আনুমানিক ১,৩০০ টন

বয়স: প্রায় ২,৭০০ বছর
 

বহুতল ভবনের ছাদে তাকানোর মতোই এই গাছের চূড়া দেখতে ঘাড় উঁচু করতে হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা একক কোনো জীবন্ত সত্তার মধ্যে আয়তনে এটি সবচেয়ে বড়।
 

সংরক্ষণের ইতিহাস-

উনবিংশ শতকের শেষ দিকে পরিবেশবাদীদের তীব্র আন্দোলনে ক্যালিফোর্নিয়ার এই বনাঞ্চলকে সরকারি সংরক্ষণে আনা হয়। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Sequoia National Park-যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দিককার জাতীয় উদ্যানগুলোর একটি। যদি সেই উদ্যোগ নেওয়া না হতো, তবে কাঠ ব্যবসায়ীদের করাতেই হয়তো চিরতরে হারিয়ে যেত পৃথিবীর এই বিস্ময়।
 

জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি-

আজকের দিনে সেকুইয়ার সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। দীর্ঘস্থায়ী খরা, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং ভয়াবহ দাবানল এদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। ২০২০ সালের ভয়াবহ আগুনে হাজার হাজার সেকুইয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীরা এখন এই গাছগুলোর DNA ব্যাংকিং ও চারা উৎপাদনের মাধ্যমে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এদের দেখতে পায়।

ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ তাদের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছে বলেই আজ সেকুইয়ার মতো বিস্ময় পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরও প্রশ্ন করা উচিত-আমরা কি আমাদের প্রাচীন বৃক্ষ ও ঐতিহ্য একইভাবে সংরক্ষণ করছি?

কারণ, প্রকৃতি রক্ষা মানে শুধু ইতিহাস টিকিয়ে রাখা নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ