এন্ডোমেট্রিওসিস: নিরাময় সম্ভব কি? মেয়েদের জীবনে এর ভয়ঙ্কর প্রভাব

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
নারীর স্বাস্থ্যের জটিল সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis)। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে জরায়ুর ভেতরের আবরণ বা এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সাধারণত এই টিস্যুটি মাসিক চক্রে জরায়ুর ভেতরে বেড়ে ওঠে ও ঝরে পড়ে। কিন্তু জরায়ুর বাইরে বেড়ে ওঠা টিস্যু স্বাভাবিক নিয়মে বের হতে না পারায় শরীরে তৈরি করে তীব্র ব্যথা, প্রদাহ এবং অনেক সময় প্রজনন সমস্যা।
রোগের প্রকৃতি:
এন্ডোমেট্রিওসিসে জরায়ুর বাইরের টিস্যুগুলো প্রায়ই পাওয়া যায়-
ডিম্বাশয় (Ovaries), ফলোপিয়ান টিউব, পেলভিক অঞ্চল, কিছু ক্ষেত্রে অন্ত্র, মূত্রথলি বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
যখন মাসিক শুরু হয়, তখন এই কোষগুলোও প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু জরায়ুর বাইরে অবস্থান করার কারণে রক্ত বা টিস্যু শরীর থেকে বের হতে পারে না। ফলে তৈরি হয় ব্যথা, ফোলা এবং টিস্যুর ক্ষত বা সিস্ট (Endometrioma)।
লক্ষণসমূহ:
এন্ডোমেট্রিওসিসকে অনেক সময় 'নীরব রোগ' বলা হয়, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই এটিকে সাধারণ মাসিক ব্যথা বলে ভুল করেন। তবে লক্ষণগুলো ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়—
⇨ মাসিকের সময় অস্বাভাবিক ও তীব্র ব্যথা
⇨ যৌন মিলনের সময় বা পরে ব্যথা
⇨ অতিরিক্ত ও অনিয়মিত রক্তক্ষরণ
⇨ দীর্ঘমেয়াদে পেলভিক ব্যথা
⇨ হজমজনিত সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি ভাব
⇨ গর্ভধারণে জটিলতা
কারণ ও ঝুঁকির বিষয়:
এন্ডোমেট্রিওসিসের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে গবেষকরা কিছু বিষয়কে দায়ী করেন—
⇨ রেট্রোগ্রেড মেনস্ট্রুয়েশন: মাসিকের রক্ত বিপরীত দিকে ফলোপিয়ান টিউব দিয়ে পেলভিক গহ্বরে ছড়িয়ে পড়া।
⇨ জেনেটিক কারণ: পরিবারে কারো এ সমস্যা থাকলে ঝুঁকি বেশি।
⇨ ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা: শরীর টিস্যুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়।
⇨ হরমোনজনিত প্রভাব: এস্ট্রোজেন হরমোন এন্ডোমেট্রিওসিসের বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে।
শারীরিক ও মানসিক প্রভাব:
এন্ডোমেট্রিওসিস নারীর জীবনকে বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে।
⇨ শারীরিকভাবে: তীব্র ব্যথা, ক্লান্তি, অ্যানিমিয়া, বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি।
⇨ মানসিকভাবে: দীর্ঘদিনের অসহনীয় যন্ত্রণা রোগীকে উদ্বেগ, হতাশা ও বিষণ্নতায় ফেলে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রজনন বয়সী নারীদের প্রায় ১০ জনে ১ জন এন্ডোমেট্রিওসিসে ভোগেন। অনেক সময় এটি সঠিকভাবে ধরা পড়তে ৭-১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা:
এন্ডোমেট্রিওসিসের স্থায়ী নিরাময় নেই, তবে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিতে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা যায়-
⇨ ওষুধ: ব্যথানাশক, হরমোনাল থেরাপি বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করে উপসর্গ কমানো হয়।
⇨ সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে অস্বাভাবিক টিস্যু অপসারণ করা হয়।
⇨ জীবনধারা পরিবর্তন: নিয়মিত ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ উপসর্গ হ্রাসে সহায়তা করে।
⇨ফার্টিলিটি চিকিৎসা: যেসব নারীর গর্ভধারণে সমস্যা হয়, তাদের জন্য ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) বা অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসা ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে সচেতনতা খুবই সীমিত। অনেক নারী মাসিকের ব্যথাকে স্বাভাবিক ভেবে চিকিৎসা নেন না। এর ফলে রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়, আর অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সমস্যা দেখা দেওয়ার পর বিষয়টি সামনে আসে। মানসিক স্বাস্থ্য ও নারী-স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু এ সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
এন্ডোমেট্রিওসিস শুধু মাসিকের ব্যথা নয়, এটি নারীর জীবনের গুণগত মান নষ্ট করে দেওয়া এক দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ, নিয়মিত চিকিৎসা, এবং পরিবার ও সমাজের সহানুভূতি এ সমস্যার মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে নীরবতা ভেঙে, "ব্যথা স্বাভাবিক নয়" এই বার্তাই হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস মোকাবিলার মূলমন্ত্র।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।