ভাইরাল "টক্সিক লেডি" গ্লোরিয়া রামিরেজ: রহস্যময় মৃত্যু, পরীক্ষা ও বিতর্কের নেপথ্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
১৯৯৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রিভারসাইড জেনারেল হাসপাতালের জরুরি কক্ষে অদ্ভুত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলে চিকিৎসা-দুনিয়া তাক লাগিয়ে দেয় - ৩১ বছর বয়সী গ্লোরিয়া সিসিলিয়া রামিরেজকে (জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চূড়ান্ত পর্যায়ে) নিয়ে আসার পর তার আশেপাশে থাকা বহু হাসপাতালকর্মী দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়েন; পরে গ্লোরিয়ার মৃত্যুর পর তাকে মিডিয়ায় "Toxic Lady" বা "বিষাক্ত নারী" বলে ডাকা শুরু হয়।
মূল ঘটনার বিবরণ-
রাত ৮:১৫-এ প্যারামেডিকরা গ্লোরিয়াকে নিয়ে আসে; তিনি তীব্র হৃদপিণ্ডের অকস্মাৎ দ্রুত স্পন্দন (ট্যাচিকার্ডিয়া), শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অশান্তি ও বিভ্রান্তি নিয়ে ছিলেন।
নার্সদের দেওয়া Diazepam, Midazolam, Lorazepam ইত্যাদি সেডেটিভ ও হৃৎরোগ-প্রতি ওষুধ সত্তেও তিনি ভালো হচ্ছিলেন না; পরে ডিফিব্রিলেশন (বৈদ্যুতিক শক) দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন কর্মীরা লক্ষ্য করেন তার ত্বকে তেল-জাতীয় চকচকে আবরণ, এবং মুখ থেকে "রসুনের মতো" বা ফল-মিশ্রিত দুর্গন্ধ আসছে। একজন নার্স (Susan Kane) রক্ত টিউব তুললে টিউব থেকে অ্যামোনিয়ার মতো গন্ধ পাওয়া যায় এবং রক্তে হলুদ-বাদামী স্ফটিকজাত বিন্দু দেখা যায়। সেই মুহূর্তে কয়েকজন কর্মী জ্ঞান হারান।
ঘটনার প্রায় অর্ধঘণ্টার মধ্যে জরুরি কক্ষে মোট ৩৭ জন কর্মী উপস্থিত ছিলেন; এর মধ্যে ২৩ জন অসুস্থ হন এবং পাঁচ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় (তাদের মধ্যে একজন দুই সপ্তাহ নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন)। রাত ৮:৫০-এ কিডনি ফেইলে গ্লোরিয়াকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রাথমিক তদন্ত ও ল্যাব-রিপোর্ট: DMSO তত্ত্ব উঠে আসা-
ঘটনার তীব্র অস্বাভাবিকতায় রিভারসাইড কাউন্টি ও ক্যালিফোর্নিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যাপক তদন্ত চালায়; পরে লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি (LLNL)-এর ফরেনসিক টিম ঘটনাটির রাসায়নিক ব্যাখ্যা প্রস্তাব করে— তারা অনুমান করে গ্লোরিয়া হয়তো ব্যথানাশক হিসেবে ডাইমিথাইল সালফক্সাইড (DMSO) ব্যবহার করছিলেন (কিছু লোক DMSO-এর গন্ধকে 'রসুনজাত' বলে বর্ণনা করে)। LLNL-র ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয় DMSO শরীরে অথবা ত্বকে থাকলে এবং চিকিৎসকরা/প্যারামেডিকরা অক্সিজেন দিলেন বা ভ্যাকু-ভ্যাকুটেইনের শর্তে রক্ত শীতল হলে সম্ভাব্য রাসায়নিক রূপান্তর ঘটতে পারে — DMSO → ডাইমিথাইল সালফোন (DMSO₂) → এবং তাত্পর্যপূর্ণ পরিবেশে ডাইমিথাইল সালফেট (Me₂SO₄, সাধারণত DMS)-এ রূপান্তর হয়ে যেতে পারে; ডাইমিথাইল সালফেট বাষ্প আকারে অত্যন্ত বিষাক্ত, মিউটেজেনিক ও গুরুতর শ্বাসনালীর আঘাতকারী। LLNL-এর এই বিশ্লেষণটি পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে।
DMSO ও ডাইমিথাইল সালফেট - কী ও কেন বিষয়টি উদ্বেগজনক?
☞ DMSO (ডাইমিথাইল সালফক্সাইড): শিল্প ও পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী সলভেন্ট; ত্বকে লাগালে দ্রুত শোষিত হতে পারে; অনেকে ভূতৈল্য বা পুরোনো হোমরেমেড হিসেবে ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। এর গন্ধকে কখনো 'রসুন' বলা হয়েছে।
☞ ডাইমিথাইল সালফোন (DMSO₂): DMSO-এর অক্সিডেশনের মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে; কক্ষ তাপমাত্রায় ক্রিস্টালাইজেশন ধারণা করা হয়েছে ওই ঘটনার ক্ষেত্রে।
☞ ডাইমিথাইল সালফেট (Me₂SO₄ বা DMS): একটি শক্তিশালী অ্যালকাইলেটিং এজেন্ট; বাষ্প শ্বাসপ্রশ্বাসে গেলে চোখ, নাক, গলা ও ফুসফুসে জ্বালা, ক্ষত, শ্বাসকষ্ট, কঞ্জেশন এবং সিস্টেমিক ক্ষতি (কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্রে) ঘটায়; ইটোপিক্যাল অ্যাক্সিডেন্টাল এক্সপোজার-এর ক্ষেত্রে লেটেন্ট (দেরিতে প্রকাশিত) লক্ষণও দেখা যায়। সাধারণভাবে এটি গবেষণাগারে 'বইয়ের বিরুদ্ধে' অত্যন্ত বিপজ্জনক পদার্থ হিসেবে বিবেচিত।
LLNL-র গবেষকরা ল্যাব-পর্যায়ে কিছু পরিস্থিতি পুনরায় সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এবং রাসায়নিক রূপান্তরের একটি সম্ভাব্য পথ প্রস্তাব করেছিলেন; এই ব্যাখ্যা অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়- যেমন দেহে তৈলাক্ত আবরণ, রক্তের ভেতরে স্ফটিক এবং কর্মীদের শ্বাসনালী-লক্ষণ ইত্যাদি। ফলে রিভারসাইড করোনারের অফিসও তাদের রিপোর্টকে গুরুত্ব দেয়।
তবে বহু জৈব-রসায়নবিদ ও বিষবিজ্ঞানী এই নীতি-রূপান্তরকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেন না- তাদের যুক্তি: মানবদেহের মধ্যের তাপমাত্রা, প্রতিক্রিয়ার গতি এবং ঘটনাস্থলের পরিবেশ এই ত্বরান্বিত রূপান্তরকে সহজতর করবে কি না তা অনিশ্চিত; অনেকের মতে এমন দ্রুত ও এত পরিমাণে গ্যাসীয় বিষ তৈরি হওয়া কঠিন। কিছু তদন্তকারী দল সেটিকে ম্যাস (সামাজিক) সাইকোজেনিক অসুখ (mass psychogenic illness) হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছে। ফলে এই ঘটনার চূড়ান্ত নির্ভুল কারণ আজও বিতর্কিত।
গণ-হিস্টিরিয়া (Mass psychogenic illness) - কি-ই বা তা? এবং রিভারসাইড কিভাবে ফিট করে!
ম্যাস সোশিওজেনিক অসুখ হলো এক ধরনের মানসিক-সামাজিক ঘটনাবলি যেখানে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে শারীরিক লক্ষণ দ্রুত ছড়ায়, অথচ ব্যাক-এন্ডে কোনো সংক্রামক বা সহজভাবে চিহ্নিতযোগ্য পরিবেশগত উৎস থাকে না। এটি প্রায়ই তীব্র উদ্বেগ, দৃশ্য বা গন্ধ দ্বারা প্ররোচিত হয় এবং নারী কর্মীরা তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাবিত হয়-এটি রিভারসাইড ঘটনার কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়; তাছাড়া তদন্তকারীরা এটা বিবেচনা করেছেন কারণ অনেক আক্রান্তের রক্ত পরীক্ষা স্বাভাবিক দেখায় এবং আক্রান্তরা তৎক্ষণাৎই গুরুতর বৈজ্ঞানিক-ভিত্তিক বিষক্রিয়ার প্রবল প্রমাণ দিল না। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা একেবারেই সকল প্রশ্নের উত্তর দেয় না-বিশেষত রক্তে স্ফটিক ও ব্যক্তিগত লং-টার্ম ক্ষতির প্রমাণ থাকা অবস্থায়।
হাসপাতালের প্রতিক্রিয়া, তদন্ত ও পরিবারের অবস্থান-
রিভারসাইড কাউন্টি, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট স্বাস্থ্য বিভাগের টিম, LLNL-সহ একাধিক সংস্থা দীর্ঘ তদন্ত চালায়; নানা ল্যাবরুম পরীক্ষায় "নির্দিষ্ট বহিরাগত বিষ" পাওয়া যায়নি বলেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। শেষ পর্যন্ত করোনার রিপোর্টে গ্লোরিয়ার মৃত্যুকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জটিলতায় উদ্ভুত কিডনি-ব্যর্থতার ফলে হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিকতা (cardiac dysrhythmia leading to renal failure) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে পরিবার – বিশেষত তার বোন — হাসপাতালের দুর্বলতা ও তদন্তের ধীরগতিকে নিয়ে আপত্তি করে; পরিবার অনুমান করেছিল যদি হাসপাতাল-এলীনার মনোযোগের ঘাটতি না থাকত, তাহলে অন্য প্রচলিত ফল হতে পারে। গ্লোরিয়ার দেহ ২০ এপ্রিল ১৯৯৪-এ কবর দেওয়া হয়। (Los Angeles Times)
গ্লোরিয়া রামিরেজের রাতটি-এবং তার পরে যে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও ল্যাব-পরীক্ষকরা মাসের পর মাস খুঁটিনাটি তদন্ত চালিয়েছেন-হাসপাতাল নিরাপত্তা, ফরেনসিক-রসায়ন ও মানব আচরণ-মনস্তত্ত্বের ছায়াপথে এক জটিল মেলবন্ধন হিসেবে রয়ে গেছে। LLNL-এর রাসায়নিক-তত্ত্ব একদিকে অনেক প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দেয়; অন্যদিকে রসায়নবিদদের শংকা ও "মাস সাইকোজেনিক" ব্যাখ্যা দর্শায় যে এই ঘটনার চূড়ান্ত, একক ও সার্বজনিন সত্য ধারণা করা আজও কঠিন। ইতিহাসে এই কাহিনী রোগীর দুঃখজনক মৃত্যু, অসুস্থ চিকিৎসক-নার্সদের কষ্ট, এবং বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার এক কঠোর পাঠ হয়ে রয়ে যায়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।