বুলিমিয়া নার্ভোসা: খাওয়ার নেশা কি মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে? কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ ও চিকিৎসা জানুন

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
খাওয়া মানে শুধু ক্ষুধা মেটানো নয়, আনন্দ, সামাজিকতা আর মানসিক প্রশান্তিরও একটি বড় উৎস। কিন্তু যখন এই খাবারই পরিণত হয় আতঙ্কে, তখন জন্ম নেয় এক ভয়াবহ ব্যাধি-বুলিমিয়া নার্ভোসা। বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়তে থাকা এই খাদ্যজনিত ব্যাধি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও মারাত্মক ক্ষতিকর।
কী এই বুলিমিয়া নার্ভোসা?
সহজভাবে বললে, এটি এমন একটি মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি অল্প সময়ে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলেন-যাকে ইংরেজিতে বলা হয় binge eating। কিন্তু খাওয়া শেষ হতেই ভয় তৈরি হয়, "ওজন বেড়ে যাবে"। আর সেই ভয় থেকেই শুরু হয় compensatory behavior-যেমন ইচ্ছাকৃত বমি করা, মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম, উপবাস কিংবা হজমকারী ওষুধের অপব্যবহার।
গ্রিক শব্দ bulimia অর্থ "অসীম ক্ষুধা"। নামটি যেমন, বাস্তবতাও তাই-এই রোগে ভোগা মানুষ যেন এক অদম্য ক্ষুধা আর ওজন বৃদ্ধির আতঙ্কের মধ্যে দোল খেতে থাকে।
কেন হয় এ রোগ?
বুলিমিয়া নার্ভোসার মূল শিকড় থাকে মনের ভেতরে। গবেষণায় দেখা যায়-
⇨ নিজের শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা,
⇨ আত্মমর্যাদার অভাব,
⇨ শৈশব বা কৈশোরে মানসিক আঘাত, নির্যাতনের অভিজ্ঞতা,
⇨ জীবনের চাপে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা- এসব মিলেই তৈরি করে এই ব্যাধি।
⇨ এমনকি বর্তমান সময়ের "স্লিম বডি কালচার", সোশ্যাল মিডিয়ার ভিজ্যুয়াল প্রভাবও তরুণ-তরুণীদের ভেতর ওজন নিয়ে অস্বাস্থ্যকর ভয় তৈরি করছে।
কারা বেশি আক্রান্ত হন?
যদিও তরুণী নারীদের মধ্যেই এটি বেশি দেখা যায়, তবে পুরুষরাও এর বাইরে নন। যেকোনো বয়সেই বুলিমিয়ার শিকার হওয়া সম্ভব, বিশেষত যদি ব্যক্তি সব সময় নিজের দেহগঠন নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন।
লক্ষণগুলো যেভাবে বোঝা যায়-
বুলিমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় তিনটি স্তরে-শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত।
➤ শারীরিক লক্ষণ
◑ হঠাৎ ওজন ওঠানামা,
◑ দাঁত হলুদ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া (বমির অ্যাসিডে ক্ষয়),
◑ গলা ও গালে ঘন ঘন ক্ষত,
◑ দুর্বলতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিয়মিত ঋতুচক্র।
➤ মানসিক লক্ষণ
◑ নিজেকে সবসময় মোটা মনে হওয়া,
◑ খাবার খাওয়ার পর লজ্জা বা অপরাধবোধ,
◑ আত্মসম্মানহীনতা,
◑ বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তা।
➤ আচরণগত লক্ষণ
◑ একা একা বা লুকিয়ে খাবার খাওয়া,
◑ খাবারের পরপরই টয়লেটে যাওয়া,
◑ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ব্যায়াম করা,
◑ খাবার নিয়ে মিথ্যা বলা।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা বড়?
বুলিমিয়া নার্ভোসা শরীরকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অতিরিক্ত বমি ও ওষুধের কারণে শরীর থেকে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম বেরিয়ে যায়। এর ফলে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে, এমনকি হঠাৎ হৃদ্রোগে মৃত্যুও ঘটতে পারে। বারবার বমি করার কারণে দাঁত ও মুখের ক্ষতি, সংক্রমণ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মহিলাদের সন্তান ধারণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় থাকলে ঝুঁকি আরও মারাত্মক-
◑ মিসক্যারেজ, ডায়াবেটিস বা শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে।
◑ মানসিক দিক থেকেও দেখা দেয় আত্মহত্যার প্রবণতা।
চিকিৎসা যেভাবে হয়-
সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হলো-এই রোগীরা নিজেরাই অনেক সময় সমস্যাকে লুকিয়ে রাখেন। তাই পরিবার বা কাছের মানুষদের সতর্ক থাকতে হবে।
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো খাওয়া ও বমির চক্র ভাঙা এবং শরীর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করা।
নিয়মিত সময়ে খাবার খাওয়া, ক্ষুধা লাগার অপেক্ষা না করে ছোট ছোট বিরতিতে খাওয়া, খাবারের স্বাদ, গঠন ও অভিজ্ঞতাকে সচেতনভাবে উপভোগ করা,
নিজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা, মানসিক থেরাপির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো।
প্রয়োজনে ওষুধের সাহায্যে ইনফেকশন, অ্যানিমিয়া বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সামাল দিতে হয়।
করণীয়
যদি পরিবারের কারো মধ্যে বুলিমিয়ার আচরণ লক্ষ্য করেন-
⇨ সমালোচনা বা দোষারোপ না করে সহানুভূতি দেখান,
⇨ বিচার করার বদলে তার কথা মন দিয়ে শুনুন,
⇨ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভালো উদাহরণ তুলে ধরুন,
⇨ প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে উৎসাহিত করুন।
বুলিমিয়া নার্ভোসা কোনো খেয়ালী অভ্যাস নয়, এটি একটি জটিল মানসিক ও শারীরিক রোগ। সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি সম্ভব। খাবার আনন্দ দেবে, আতঙ্ক নয়-এই সহজ সত্যটিই হতে পারে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।