বিষাক্ত পুরুষের দমনাত্মক প্রভাব: সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
পুরুষ মানেই কঠোর, কান্নাহীন, প্রভুত্বশালী এই ধারণা আমাদের সমাজে এতটাই গেঁথে গেছে যে তা প্রায় সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ধারণাই যখন সহিংসতা, নারীবিদ্বেষ, সমকামী কিংবা মানসিক সমস্যাকে প্রশ্রয় দেয়, তখন সেটিকে বলা হয় "বিষাক্ত পৌরুষ" (Toxic Masculinity)। এটি কেবল ব্যক্তিগত আচরণের সমস্যা নয়; বরং সামাজিক গঠন ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। "বিষাক্ত পৌরুষ" শব্দটি প্রথম জনপ্রিয় হয় ১৯৮০–৯০ এর দশকে, কিছু লেখকের মাধ্যমে যারা বলেছিলেন-আধুনিক সমাজে পুরুষরা তাদের "বাস্তব" বা "গভীর" পৌরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
বিষাক্ত পৌরুষ আসলে কী?
"বিষাক্ত পৌরুষ" বলতে বোঝায় পুরুষত্বের এমন দিক, যা ধ্বংসাত্মক ও অসুস্থ মানসিকতা তৈরি করে। যেমন:
◑ নারীবিদ্বেষ: নারীদের প্রতি বৈরিতা বা অবমূল্যায়ন।
◑ আধিপত্যবাদী আচরণ: অন্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা।
◑ সহিংসতা: প্রমাণ করার জন্য আগ্রাসন বা মারামারি ব্যবহার।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে "বিষাক্ত" বলা হয় কারণ এগুলো শুধু অন্যদের ক্ষতি করে না, বরং পুরুষদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যও বিপর্যস্ত করে।
আমাদের সমাজে ছোট ছেলেদের শেখানো হয়-"ছেলেরা কাঁদে না", "ছেলেরা শক্তিশালী", "ছেলেরা মারামারি করলে দোষ নেই। এর ফলে ছেলেরা আবেগ দমন করতে শেখে, আর সহিংসতা বা আগ্রাসনকে স্বাভাবিক মনে করে। "Boys will be boys"-এই কথাটি শোনায় নির্দোষ মনে হলেও, আসলে এটি সহিংসতা বা দুষ্টামিকে বৈধতা দেয়। আবেগ প্রকাশ না করতে পারায় তারা চাপে থাকে, যা পরে অনেক সময়ই মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে।
বিষাক্ত পৌরুষ কেবল সমাজেই নয়, পুরুষদের নিজেদের ভেতরেও সংকট তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে:
আবেগ দমন পুরুষদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
আত্মনির্ভরশীলতার অতিরিক্ত চাপ তাদের চিকিৎসা বা মানসিক সহায়তা নিতে বাধা দেয়। মাদক ও অ্যালকোহলের ব্যবহার বাড়ে, কারণ তারা আবেগের কষ্ট অন্যভাবে ঢাকতে চায়।
যখন পৌরুষকে আধিপত্য ও শক্তির সমার্থক করে তোলা হয়, তখন তা সামাজিক সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন অনেক সময় আসে এই ধারণা থেকে যে, পুরুষের কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত। কারাগারের ভেতরে দেখা যায় একটি আলাদা "পুরুষালি কোড"যেখানে দুর্বলতা দেখানো নিষিদ্ধ, আর ক্ষমতা প্রমাণ করতে সহিংসতা ব্যবহার করা হয়।
সব পুরুষালি বৈশিষ্ট্য কি বিষাক্ত?
না। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, খেলাধুলায় সাফল্য, পরিবারকে রক্ষা বা ভরণপোষণ করার গর্ব-এসবকে বিষাক্ত বলা হয় না। সমস্যা তখনই তৈরি হয়, যখন এগুলোর আড়ালে অন্যদের ওপর আধিপত্য, নারীদের অবমূল্যায়ন বা সহিংসতা বৈধতা পায়।
কীভাবে সমাধান সম্ভব?
☞ সামাজিক শিক্ষা পরিবর্তন: ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখাতে হবে যে আবেগ প্রকাশ করা স্বাভাবিক।
☞ মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন: পুরুষদের মানসিক সমস্যাকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্বীকার করতে হবে।
☞ পজিটিভ পৌরুষ: দায়িত্বশীলতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্মান-এসব বৈশিষ্ট্যকে পুরুষত্বের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
☞ মিডিয়া ও সংস্কৃতি: সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও সংবাদে আগ্রাসী পুরুষত্বের বদলে ইতিবাচক রোল মডেল তুলে ধরা।
"পুরুষ মানেই শক্ত, আধিপত্যশালী, ভয়হীন" এই ধারণার অন্ধকার দিক আমাদের সমাজে সহিংসতা ও মানসিক রোগের বীজ বুনছে। বিষাক্ত পৌরুষ ভাঙতে হলে পুরুষদের প্রথমেই মুক্তি দিতে হবে নিজেদের আবেগ প্রকাশের অধিকার, সহমর্মিতা দেখানোর সাহস, এবং দুর্বলতাকে স্বীকার করার মানবিকতা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।