যেভাবে নিউরোপ্লাস্টিসিটি আমাদের শেখার ও অভিযোজনের পদ্ধতি বদলে দেয়

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানব মস্তিষ্ককে একসময় বিজ্ঞানীরা তুলনা করতেন একটি মেশিনের সঙ্গে। যা একবার তৈরি হয়ে গেলে আর বদলায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে নিউরোসায়েন্স প্রমাণ করেছে, মস্তিষ্ক কোনো স্থির যন্ত্র নয়। এটি ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে নতুন করে সাজায়। এই অসাধারণ ক্ষমতাকেই বলা হয় নিউরোপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity)।
এটি মস্তিষ্কের এমন এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নতুন স্নায়ু সংযোগ তৈরি হয়, পুরোনো সংযোগ দুর্বল বা শক্তিশালী হয়, এমনকি আঘাতের পরও মস্তিষ্ক নিজেকে পুনর্গঠন করে। এর ফলে শেখা, স্মৃতি, সমস্যা সমাধান, এমনকি মানসিক বিকাশও সম্ভব হয়।
নিউরোপ্লাস্টিসিটি যেভাবে কাজ করে-
⇨ সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি (Synaptic plasticity):
নিউরন বা স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যে যোগাযোগের জায়গা থাকে তাকে সিন্যাপ্স বলে। শেখা বা অনুশীলনের মাধ্যমে কিছু সিন্যাপ্স শক্তিশালী হয়, কিছু আবার দুর্বল হয়ে যায়। এভাবে নতুন তথ্য সংরক্ষণ হয়।
⇨ স্ট্রাকচারাল প্লাস্টিসিটি (Structural plasticity):
মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে নতুন সংযোগ তৈরি হয় বা অপ্রয়োজনীয় সংযোগ ছেঁটে ফেলা হয়।
⇨ নিউরোজেনেসিস (Neurogenesis):
বিশেষ করে হিপোক্যাম্পাসে (যা শেখা ও স্মৃতির সঙ্গে জড়িত) প্রাপ্তবয়স্ক বয়সেও নতুন নিউরন তৈরি হয়।
শেখার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ভাষা, অঙ্গভঙ্গি বা নতুন অভ্যাস দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি তুলনামূলকভাবে ধীর হলেও সম্পূর্ণ বন্ধ হয় না। তাই চর্চা, অনুশীলন এবং মানসিক সক্রিয়তার মাধ্যমে নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করা সম্ভব।
নিউরোপ্লাস্টিসিটির গুরুত্ব
◑ শেখা ও স্মৃতি: প্রতিদিন নতুন শব্দ, দক্ষতা বা তথ্য মনে রাখা সম্ভব হয় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
◑ আঘাত থেকে পুনরুদ্ধার: স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে আঘাতের পর রোগীরা নির্দিষ্ট থেরাপির মাধ্যমে আবার কথা বলা, হাঁটা বা কাজ শেখার সুযোগ পান।
◑ অভ্যাস গঠন: দৈনন্দিন রুটিন যেমন পড়াশোনা, ব্যায়াম বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো ধীরে ধীরে সহজ হয়ে ওঠে কারণ মস্তিষ্ক নতুন পথ তৈরি করে।
◑ মানসিক স্বাস্থ্য: সৃজনশীলতা, মনোযোগ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এমনকি বিষণ্ণতা মোকাবিলায়ও নিউরোপ্লাস্টিসিটির ভূমিকা আছে।
যেভাবে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ানো যায়-
⇨ নতুন দক্ষতা শেখা: ভাষা, বাদ্যযন্ত্র, অঙ্কন বা রান্না—যেকোনো নতুন চর্চা মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে।
⇨ শারীরিক ব্যায়াম: দৌড়, যোগ বা সাঁতার শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কেও রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং নিউরোট্রফিন নামক রাসায়নিক নিঃসরণ করে, যা স্নায়ু সংযোগকে শক্তিশালী করে।
⇨ ধ্যান ও মাইন্ডফুলনেস: নিয়মিত মেডিটেশন মনোযোগ বাড়ায়, স্ট্রেস কমায় এবং মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন ঘটায়।
⇨ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া: মানুষের সঙ্গে কথা বলা, সম্পর্ক তৈরি করা এবং দলগত কাজও নতুন সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে।
⇨ ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম স্মৃতি সংরক্ষণ ও শেখার প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য।
গবেষণায় দেখা গেছে- লন্ডনের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হিপোক্যাম্পাস অংশ অন্যান্যদের তুলনায় বড়, কারণ তারা জটিল রাস্তা ও লোকেশন মনে রাখেন নিয়মিত। সঙ্গীতশিল্পীদের মস্তিষ্কের শ্রবণ ও মোটর কর্টেক্স অংশ সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি উন্নত। স্ট্রোক রোগীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, পুনর্বাসন অনুশীলনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নতুন অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত অংশের কাজ নিতে পারে।
নিউরোপ্লাস্টিসিটি প্রমাণ করেছে যে মস্তিষ্ক একটি পরিবর্তনশীল অঙ্গ-যা শুধু শৈশবেই নয়, জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই শিখতে ও মানিয়ে নিতে সক্ষম। শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়াতে এই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো যায়। সহজভাবে বলতে গেলে, যত বেশি ব্যবহার করবেন, তত বেশি শক্তিশালী হবে আপনার মস্তিষ্ক।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।