আপনি কি সবসময় FOMO-তে ভুগছেন? লক্ষন গুলো মিলিয়ে দেখুন!!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের সকালে আপনি হয়তো নিজের ফোন খুলে দেখলেন বন্ধুদের সমুদ্রসৈকতে, কারো নতুন চাকরি পালনের ছবি, কিংবা একদিনের "পার্টির হাইলাইট" রিল। স্ক্রল চালাতে চালাতে এক মুহূর্তে মাথার ভেতর এসে ঠক দেয়: "সবাই তো এত আনন্দ করছে, আমি কেন নেই?" এই অনুভূতিই FOMO: Fear of Missing Out মিসিং আউটের ভয়।
FOMO হলো একটি বিস্তৃত মানসিক অবস্থা যেখানে কেউ অনুভব করে যে অন্যরা কোন আনন্দদায়ক বা মূল্যবান অভিজ্ঞতা উপভোগ করছে — এবং সে অভিজ্ঞতায় সে অনুপস্থিত। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সামাজিক প্রাণী; গোষ্ঠীর বাইরে থাকা বা বঞ্চিত হওয়ার ভয় আমাদের বিবর্তনের অংশ—কারণ সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তখন জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এসে এটাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে: অন্যদের জীবনের শুধুমাত্র সেরা মুহূর্তগুলোর কিউরেটেড, ঝলমলে ভার্সন প্রতিনিয়ত চোখের সামনে থাকায় তুলনা ও অনুপস্থিতির অনুভূতি তীব্র হয়।
মানসিকভাবে FOMO-র মূল চালকগুলো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার মিশ্রণ:
১। সামাজিক তুলনা (Social comparison): মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে-এটা আত্মপরিচয় নির্ধারণের একটি উপায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলনা দ্রুত ও ধারাবাহিক হয়, এবং তুলনা করলে স্বাভাবিকভাবেই আত্মসম্মান আর সন্তুষ্টিতে প্রভাব পড়ে।
২। আত্ম-সমর্থনের প্রয়োজন (Belongingness): মানুষ গোষ্ঠীর অংশ হতে চায়। এই আত্মিক চাহিদা পুরন না হলে উদ্বেগ তৈরি হয়।
৩। পুরস্কার-সিস্টেম ও নিউরোকেমিস্ট্রি: যখন আমরা 'লাইক', মন্তব্য বা সামাজিক স্বীকৃতি পাই, তখন মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্র অ্যাকটিভ হয়; এটি আনন্দ ও পুনরাবৃত্তি-চাহিদা সৃষ্টি করে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপরিশোধিত "ভেরিয়েবল রিওয়ার্ড" (কখন লাইক বা নতুন কন্টেন্ট আসবে অনিশ্চিত) সিস্টেমটি স্লট-মেশিনের মতো বারবার চেক করিয়ে দেয়।
৪। নিয়ন্ত্রণহীনতা ও ডাইনামিক তুলনা: প্ল্যাটফর্মগুলো কিউরেটেড কনটেন্ট দেখায়,রিয়েল লাইফের বিশৃঙ্খলতা দেখানো হয় না ; ফলে 'সবার জীবন' কল্পনার মতোই সুন্দর মনে হয়। এই মিশ্র প্রক্রিয়া মানুষের আচরণ, ভাবনা ও শরীরের জবাবদিহিতে প্রতিফলিত হয়—হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, অস্থিরতা, ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি দেখা যায়। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে এই ধারাবাহিক চাপ ডিপ্রেশন বা ক্রনিক স্ট্রেসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সামাজিক মিডিয়া FOMO প্রশমিত না করে আরও বাড়িয়ে দেয়। সামাজিক মিডিয়া কেবল কনটেন্ট দেখায় না; তা ব্যবহারকারীর আচরণকে আংশিকভাবে ডিজাইন করে:
⇨ কখনো লাইক/কমেন্ট বেশি, কখনো কম-এই অনিশ্চয়তা বারবার চেক করিয়ে দেয়।
⇨ মানুষ সাধারনত নিজেদের জীবনের সেরা অংশগুলোই পোস্ট করে; ফলে দর্শক সুবিধাভোগী ইমপ্রেশন পায়।
⇨ প্ল্যাটফর্মগুলো এমন কনটেন্ট দেখায় যা বিনোদন দেবে বা এঙ্গেজমেন্ট বাড়াবে—এর ফলে 'সবই গুরুত্বপূর্ণ' মনে হয়, ও মিস না করতে চাইলে বারবার চেক করতে হয়।
⇨ স্টোরি, রিল, হাইলাইট—সবই সময়গত চাপ তৈরি করে: 'আমি যদি এখন না দেখি, তখন আমি মিস করব'—এমন ভাবনা জন্মায়।
লক্ষণ ও আচরণগত নমুনা-
FOMO প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা রূপে দেখা দিতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ:
⇨ ক্রমাগত ফোন চেক করা, বিশেষ করে সোশ্যাল অ্যাপগুলো;
⇨ ইভেন্ট বা সুযোগ মিস হওয়া নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা;
⇨ আত্মসম্মান-হ্রাস বা অসাম্যতার অনুভূতি;
⇨ ঘুমের ব্যাঘাত বা মনোযোগে সমস্যা;
⇨ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও ভেতরে খালি/অসন্তুষ্ট লাগা;
⇨ কাজ বা পড়াশোনায় মন না থাকা;
⇨ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হারানো।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
FOMO দীর্ঘ সময় বজায় থাকলে ব্যক্তি-স্তরের কিছু নেতিবাচক পরিণতি হতে পারে: ক্রনিক উদ্বেগ, নিম্ন আত্মমর্যাদা, সম্পর্কের গভীরতার অভাব, কাজের দক্ষতা হ্রাস, ও ঘুমের বিঘ্ন। এছাড়া অনেকে অনানুষ্ঠানিক খরচ (ইভেন্টে যাওয়ার জন্য বেশি খরচ) বা অস্থির সম্পর্ক গঠন করতে পারেন যা আর্থিক এবং মানসিক চাপ বাড়ায়।
যেভাবে মোকাবিলা করবেন -
নিচের উপায়গুলো ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োগ করলে FOMO-র তীব্রতা কমে এবং জীবনের মান বাড়তে পারে। প্রতিটি পদক্ষেপই সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক পরামর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু যদি আপনার উপসর্গ গুরুতর হয় (দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত, আত্মহত্যাপ্রবণ চিন্তা), পেশাদার সাহায্য নিন।
১) সচেতনতা ও ট্র্যাকিং (Week 1: পর্যবেক্ষণ):
প্রতিদিন দুই দিন ফোনের লক স্ক্রিন খোলা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমের আগে পর্যন্ত কতো সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগছে একটি সহজ নোটবুক বা অ্যাপে লিখুন। স্ক্রল করার সময় কী অনুভব করছেন—ঈর্ষা, খালি শরীর, আনন্দ? ছোট নোট রাখুন। প্রতিদিনের শেষে এক পংক্তিতে লিখুন আজ আমি কী করেছি যা বাস্তবে আমার আনন্দ বাড়িয়েছে? (যদি কিছু না হয়, দেখুন কেন না)।
২) সীমা নির্ধারণ ও ডিজিটাল হাইজিন (Week 2: ছোট পরিবর্তন): নোটিফিকেশন বন্ধ করুন — বিশেষ করে 'লাইক' বা 'নতুন ফলোয়ার' আলার্ম। ফোনে 'অ্যাপ টাইমিং' সেট করুন: প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট সোশ্যাল স্ক্রল নির্ধারণ করুন, বাকি সময় অ্যাপ লক করুন। ঘুমের ৬০ মিনিট আগে ফোন রেখে দিন অন্য ঘরে—স্ক্রিন টাইম কমলে মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায়।
৩) কগনিটিভ-ব্যবহারিক কৌশল (Week 3: মানসিক রিকনস্ট্রাকশন):
◑ বাক্য-রিফ্রেমিং: প্রতিবার যখন মনে হবে "আমি মিস করছি", বলুন—"আমি শুধু তাদের সেরা অংশগুলো দেখছি; সেগুলো পুরো বাস্তব নয়।"
◑ গ্র্যাটিচুড অনুশীলন: প্রতিদিন সকালে বা রাতে ৩টি জিনিস লিখুন—যাতে আপনি কৃতজ্ঞ। এটি তুলনা-মানসিকতা কমায়।
◑ প্রমাণ যাচাই: কোনো পোস্ট দেখে অস্থির হলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন—"এই পোস্টের কোন তথ্য আছে যা আমার জীবনকে প্রভাবিত করে?"—সাধারণত উত্তর হবে 'না'।
৪) আচরণিক বিকল্প ও অর্থপূর্ণ যুক্তি (Week 4: প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ): সোশ্যাল নেটওয়ার্কে একটা মানসিক "বাজেট" নির্ধারণ করুন—সপ্তাহে একদিন সোশ্যাল-ফ্রি দিন। বিকল্প হবি বা শখ গড়ে তুলুন। যেমন -পাঠ্য, ব্যায়াম, বানানো কাজ, গিটার বাজানো ইত্যাদি, যা পরিপূর্ণতা দেয়।গভীর সম্পর্ক তৈরি করুন। ক্ষুদ্র সংখ্যক মানুষ নিয়ে মানসম্পন্ন কথোপকথন ও সময় কাটান; সংখ্যার চেয়ে গভীরতাই জরুরি।
দ্রুত-প্রয়োগ্য কৌশল -
ফোনে এয়ারপ্লেন মোড চালিয়ে ১০ মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন করুন। স্ক্রল চালানোর আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: "এই মুহূর্তে আমি কি জানতে বা দেখে কি লাভ করব?" যদি উওর হয় "না" তাহলে ঢুকবেন না।
যখন পেশাদারের সাহায্য নেবেন-
যদি FOMO-র কারণে ঘুম কমে যায়, কাজ বা পড়াশোনায় ধারাবাহিক সমস্যা হয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা গড়ে ওঠে, অথবা আত্মহত্যা-সম্পর্কিত চিন্তা দেখা দেয়। তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। থেরাপিতে কগনিটিভ-বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT), মননশীলতা ভিত্তিক কৌশল, বা আচরণগত পরিবর্তন পরিকল্পনা সহায়ক হতে পারে।
কিশোর ও কিশোরাবস্থায় FOMO বিশেষভাবে প্রবল হতে পারে। কারণ এই বয়সে সামাজিক গ্রহণ ও আত্মপরিচয় গঠনের প্রসেস তীব্র থাকে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের উচিত স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল লিটারেসি, স্বাচ্ছন্দ্য শেখানো ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গঠন শেখানো,যাতে কেবল প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতা নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রাখা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া FOMO বাড়ায় কিন্তু পুরো দায় কেবল প্রযুক্তির নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, অস্থির কর্ম-জীবন, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত প্রত্যাশা -এসব মিলে এই অনুভূতিকে শক্ত করে। ফলে সমাধানও কেবল ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা নয়; শিক্ষা, সামাজিক নীতিমালা এবং ডিজাইন-সম্পর্কিত নীতিও গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ, প্ল্যাটফর্মগুলো যদি কিউরেটেড স্টোরির পাশে নরম ট্রান্সপারেন্সি বর্ধিত করে বা নোটিফিকেশন নীতিতে ন্যূনতমতা রাখে, তা সহায়ক হতে পারে।
একটি মানসিক স্টেট যেটা আধুনিক প্রযুক্তি ও সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে মিশে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। বুঝে নেওয়া, সীমা ঠিক করা, মানসিক কৌশল শেখা এবং অর্থপূর্ণ জীবনের ওপর ফোকাস ফিরে আনা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।