নিজেকেই অচেনা মনে হচ্ছে? কিছুই মনে রাখতে পারছেন না? ডিসোসিয়েশন ডিজঅর্ডার হতে পারে কারণ!!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানব মস্তিষ্কের ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক জটিল গোলকধাঁধা। সেই গোলকধাঁধায় অনেক সময় এমন কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যা মানুষকে নিজের সাথেই দূরত্ব তৈরি করতে বাধ্য করে। এই অবস্থাকেই বলা হয় ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার। এটি একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ তার স্মৃতি, চেতনা, পরিচয় কিংবা বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। সহজ ভাষায়, মনের ভেতর ভেঙে যাওয়া অংশগুলো আর একে অপরের সাথে মিলেমিশে কাজ করে না।
কী ঘটে এই ব্যাধিতে?
ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো হঠাৎ করে নিজের অতীত ভুলে যান, কখনো আবার মনে হয় তিনি যেন অন্য কারও জীবনে বাস করছেন। কারও কারও কাছে মনে হয় চারপাশের বাস্তব জগৎ আসলে স্বপ্নের মতো ভাসমান। এ যেন নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে নিজেকে দেখা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, এটি একটি প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া (defense mechanism)। যখন কেউ প্রচণ্ড মানসিক চাপ, আঘাত বা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যায়-তখন মস্তিষ্ক সেই যন্ত্রণাকে সহ্য করতে না পেরে নিজেকে "বিচ্ছিন্ন" করে ফেলে। ফলে ব্যক্তি কিছু স্মৃতি চেপে রাখে, অথবা একেবারেই মনে রাখতে পারে না।
ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার এক রকম নয়। গবেষকরা সাধারণত কয়েকটি ধরনে ভাগ করেন। প্রধান কয়েকটি ধরণ-
◑ ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া (Dissociative Amnesia): হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা জীবনের অংশ বিশেষ ভুলে যাওয়া। যেমন—কারো নাম, ঠিকানা, বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনা।
◑ ডিপারসোনালাইজেশন/ডিরিয়ালাইজেশন ডিজঅর্ডার (Depersonalization/Derealization Disorder): নিজের শরীর, অনুভূতি বা চারপাশের জগৎকে অবাস্তব মনে হওয়া।
◑ ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার (DID): একই মানুষের মধ্যে একাধিক আলাদা পরিচয় বা "ব্যক্তিত্ব" সক্রিয় হয়ে ওঠা। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে একে অনেকে "মাল্টিপল পার্সোনালিটি" বলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল কারণ হলো শৈশবের ট্রমা, নির্যাতন, দুর্ঘটনা, কিংবা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ। শিশু অবস্থায় যখন মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি, তখন বড় কোনো ট্রমা মস্তিষ্ককে ভেঙে আলাদা অংশে ভাগ করে দিতে পারে। পরে সেই ভাঙন থেকেই তৈরি হয় ডিসোসিয়েশন।
এই ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। শিক্ষাজীবন, কর্মক্ষেত্র, পরিবার কিংবা সামাজিক সম্পর্ক—সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় মানুষ নিজেকেই চিনতে পারে না, ফলে অভ্যন্তরীণ ভয়, বিভ্রান্তি ও আত্মসম্মানবোধের ভাঙন দেখা দেয়। সমাজে ভুল বোঝাবুঝি ও কলঙ্কের কারণে রোগীরা আরও একা হয়ে পড়েন।
চিকিৎসা ও করণীয়:
ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডারের জন্য কোনো একক ওষুধ নেই। তবে সাইকোথেরাপি বা কথোপকথনভিত্তিক চিকিৎসা সবচেয়ে কার্যকর। এর মাধ্যমে রোগীকে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের ভয়, দুঃখ ও ট্রমার মুখোমুখি হতে সাহায্য করা হয়। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), ট্রমা-ফোকাসড থেরাপি, এবং হিপনোথেরাপি অনেক ক্ষেত্রেই কাজে দেয়। একই সঙ্গে সঠিক সামাজিক সমর্থন, সহমর্মিতা ও পরিবার-বন্ধুর বোঝাপড়া রোগীর জন্য অত্যন্ত জরুরি।
কেন সচেতনতা জরুরি?
ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার নিয়ে এখনো অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। কেউ ভাবেন এটি অভিনয়, কেউ আবার অতিরঞ্জিত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। বাস্তবে এটি একেবারেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই সমাজে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
সারকথা, ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মস্তিষ্ক শুধু একটি অঙ্গ নয়, এটি মানবজীবনের জটিলতম রহস্যভাণ্ডার। ভেতরের ভাঙনগুলো অদৃশ্য হলেও এর প্রভাব বাস্তব জীবনে ভীষণ তীব্র। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও সমর্থন পেলে রোগী আবারও নিজের হারিয়ে যাওয়া অংশগুলোকে খুঁজে পেতে পারেন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।