রিলেশনশিপ অ্যানজাইটি হতে পারে আপনার সম্পর্ক ধ্বংসের কারণ!

রিলেশনশিপ অ্যানজাইটি হতে পারে আপনার সম্পর্ক ধ্বংসের  কারণ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ভালোবাসা মানবজীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগগুলোর একটি। এটি মানুষকে নিরাপত্তা, আনন্দ এবং মানসিক শান্তি দেয়। কিন্তু যখন সেই সম্পর্কের ভেতরেই প্রবেশ করে সন্দেহ, ভয় আর অস্থিরতা,তখন ভালোবাসার উষ্ণতা বদলে যায় দুশ্চিন্তায়। একে বলে রিলেশনশিপ অ্যানজাইটি বা সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তা। এটি শুধু হালকা উদ্বেগ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান সামাজিক চাপ, ডিজিটাল যোগাযোগের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, এবং সম্পর্কের ভঙ্গুরতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করছে।

উপসর্গ:  সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তার কয়েকটি সাধারণ চিহ্ন হলো-

⇨ সব সময় সঙ্গীর ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করা।

⇨ সঙ্গীর সামান্য ব্যস্ততাতেই ভেবে নেওয়া, "সে হয়তো আমাকে আর গুরুত্ব দিচ্ছে না"।

⇨ বারবার ফোন/মেসেজ চেক করা বা উত্তর না পেলে অতিরিক্ত অস্থিরতা।

⇨ ছোটখাটো বিষয়েও অতিরিক্ত ঝগড়া বা মনোমালিন্য।

⇨ ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ভয়-"সে হয়তো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে"।

⇨ অতিরিক্ত আত্মসমালোচনা: নিজের চেহারা, আচরণ বা সামর্থ্য নিয়ে অস্বস্তি।
 

- এগুলো শুধু সম্পর্কের সুখ নষ্ট করে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে হতাশা, ঘুমের সমস্যা, এমনকি প্যানিক অ্যাটাকের মতো শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

মনোবিজ্ঞান বলছে, উদ্বেগ তৈরি হলে মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা (Amygdala) নামক অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ভয়ের প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তোলে। একই সময়ে কর্টিসল (Cortisol) নামক চাপ-হরমোন নিঃসৃত হয়, যা হৃদস্পন্দন বাড়ায়, শরীরকে সতর্ক অবস্থায় রাখে। সম্পর্কে সন্দেহ ও দুশ্চিন্তা বারবার হলে এই প্রক্রিয়া অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন মস্তিষ্ক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও বিপদ অনুভব করতে শুরু করে। ফলে অতি প্রতিক্রিয়া, অতিসন্দেহ এবং অস্থিরতা ক্রমে স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।

 

কেন জন্ম নেয় এই উদ্বেগ?

⇨ শৈশবের অভিজ্ঞতা: পরিবারে অবহেলা, নিরাপত্তাহীনতা বা মানসিক নির্যাতনের শিকার শিশুরা বড় হয়ে সম্পর্কের ভেতর সহজে আস্থা রাখতে পারেন না।

⇨ অতীত সম্পর্কের ক্ষত: বিশ্বাসঘাতকতা, হঠাৎ বিচ্ছেদ বা প্রতারণার অভিজ্ঞতা নতুন সম্পর্কে অতিরিক্ত ভয় তৈরি করে।

⇨ ব্যক্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য: যাদের আত্মবিশ্বাস কম, বা যাদের মধ্যে পারফেকশনিজম প্রবল, তারা সহজেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন।

⇨ সামাজিক চাপ: সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলনা, "পারফেক্ট কাপল" এর ছবি দেখা, কিংবা অন্যদের মতামত-এসব থেকেও অনিশ্চয়তা বাড়ে।

⇨ সংযুক্তির ধরণ (Attachment Style): গবেষণা বলছে, শৈশবে যাদের নিরাপদ আবেগীয় সংযোগ (secure attachment) তৈরি হয়নি, তারা প্রাপ্তবয়সে সম্পর্ক নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হন।
 

গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রিলেশনশিপ অ্যানজাইটির হার সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রে করা এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪০% তরুণ দম্পতি নিয়মিত সম্পর্কভিত্তিক উদ্বেগ অনুভব করেন। ইউরোপে ৩০ বছরের নিচে দম্পতিদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে থেরাপি নিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে পরিবারভিত্তিক সামাজিক চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও "সমাজ কী বলবে" সংস্কৃতিও উদ্বেগ বাড়ায়। বাংলাদেশেও নগর জীবনে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই একে সাধারণ আবেগ ভেবে উপেক্ষা করেন, কিন্তু বাস্তবে এটি মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে।

 

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: রিলেশনশিপ অ্যানজাইটি দীর্ঘস্থায়ী হলে-

◑ সম্পর্কের ভেতরে আনন্দ কমে যায়।

◑ অতিরিক্ত ঝগড়া ও ভুল বোঝাবুঝিতে সম্পর্ক ভেঙে যায়।

◑ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাজীবনেও ক্ষতি হয়।

◑ ব্যক্তির আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে।

◑ একাকিত্ব ও হতাশার কারণে বিষণ্নতা (Depression) পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি কৌশল অনুসরণ করলে এ সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব-

⇨ খোলামেলা কথা বলা: সঙ্গীর সাথে নিজের ভয় ও দুশ্চিন্তার কথা লুকিয়ে না রেখে শেয়ার করা।

⇨ মননশীলতা (Mindfulness): বর্তমান মুহূর্তে বাঁচা এবং অতিরিক্ত ভবিষ্যৎভয় থেকে দূরে থাকা।

⇨ আত্মসম্মান বৃদ্ধি: নিজেকে মূল্যায়ন করা, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।

⇨ ডিজিটাল ডিটক্স: অযথা সোশ্যাল মিডিয়া তুলনা এড়ানো।

⇨ থেরাপি: সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং-যেমন CBT (Cognitive Behavioral Therapy)—রোগীকে নিজের চিন্তার ধরন পরিবর্তনে সহায়তা করে।

⇨ শারীরিক যত্ন: পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য মানসিক চাপ কমায়।
 

কেন সচেতনতা জরুরি?

ভালোবাসার সম্পর্ককে আমরা প্রায়ই শুধু আনন্দের জায়গা মনে করি। কিন্তু বাস্তবে এটি দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা ও ভয়ের কেন্দ্রও হতে পারে। রিলেশনশিপ অ্যানজাইটি নিয়ে সমাজে এখনো আলোচনা কম, ফলে অনেকেই নীরবে ভুগে যান। সচেতনতা বাড়লে মানুষ বুঝতে পারবেন—এটি কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং একটি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।

শেষ কথা হলো, ভালোবাসা মানে কেবল আবেগের মিলন নয়-এতে থাকে বিশ্বাস, ধৈর্য ও বোঝাপড়া। সম্পর্কের ভেতরের দুশ্চিন্তা যদি সময়মতো চিহ্নিত করে মোকাবিলা করা যায়, তবে অস্থিরতার জায়গায় আসবে শান্তি, সন্দেহের জায়গায় আসবে আস্থা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ