গাছ কি বোঝে মানুষের কথা ?-লোকবিশ্বাস, ধর্মীয় সতর্কতা আর আধুনিক বিজ্ঞানের অজানা সব সত্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষ বহু যুগ ধরে গাছকে শুধু খাদ্য, ছায়া কিংবা কাঠের উৎস হিসেবে নয়, বরং রহস্যময় জীব হিসেবে কল্পনা করেছে। "গাছ আমাদের কথা শোনে", "গানের সুরে গাছ বেড়ে ওঠে"-এসব লোককথা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। আবার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে গাছের নীচে রাতে ঘুমানো নিয়ে সতর্কবার্তাও প্রচলিত। প্রশ্ন হলো -এসব বিশ্বাসের পেছনে কতটা সত্য আছে? আধুনিক বিজ্ঞান কী বলছে?
মানুষের মতো উদ্ভিদের কান নেই। কিন্তু গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, গাছ কম্পন ও শব্দ তরঙ্গ অনুভব করতে পারে। উদ্ভিদের কোষে বিশেষ প্রোটিন ও রিসেপ্টর আছে, যা যেকোনো শব্দ-তরঙ্গের কম্পনকে রাসায়নিক সংকেতে রূপান্তরিত করে।
ইসরায়েল ও অস্ট্রেলিয়ার একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, শিকড় মাটির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পানির শব্দ শনাক্ত করতে পারে। ফলস্বরূপ শিকড় সেই দিকে বাড়তে থাকে। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পরীক্ষায়ও দেখা গেছে, কোমল সুরেলা সঙ্গীত গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, আর উচ্চ শব্দ বা কোলাহল অনেক ক্ষেত্রে তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এমনকি গাছ আঘাত পেলে বা কাটা হলে আশেপাশের গাছে এক ধরনের রাসায়নিক সংকেত ছড়ায়, যা তাদের প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ উদ্ভিদের ভেতরে এক ধরনের "যোগাযোগ ব্যবস্থা" কাজ করে।
এ থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, উদ্ভিদ কেবল আলো আর পুষ্টিই নয়, শব্দ ও পরিবেশের সূক্ষ্ম সংকেতও বোঝে।
লোকবিশ্বাস: গাছের নীচে ঘুমানোর নিষেধ
বাংলার গ্রামীণ সমাজ থেকে শুরু করে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সব জায়গাতেই একটি সতর্কতা প্রচলিত ছিল: "বড় গাছের নীচে রাতে ঘুমিও না।" অনেকে একে ভূতপ্রেতের কাহিনীর সাথে জুড়েছেন। ধর্মীয়ভাবে হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বট বা অশ্বত্থ গাছ পবিত্র হলেও রাতে এর নিচে বসা বা ঘুমানো উচিত নয়।
ইসলামিক সংস্কৃতিতেও রাতে বড় গাছের তলায় অবস্থান না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা অনেক সময় দুষ্টু জ্বীনদের ভয় বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দেখাচ্ছে, এই সতর্কতার পেছনে স্বাস্থ্যগত কারণ লুকিয়ে আছে।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:
অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের খেলা- দিনে গাছ ফটোসিনথেসিসের মাধ্যমে অক্সিজেন ছাড়ে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।
রাতে আলো না থাকায় ফটোসিনথেসিস বন্ধ হয়ে যায়। তখন গাছ মানুষের মতোই অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। বিশেষ করে বড় গাছ (বট, অশ্বত্থ, পিপল) এর নিচে রাতে জমে থাকা বাতাসে অক্সিজেন কমে যায়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় সেখানে ঘুমালে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ প্রাচীন সংস্কৃতির সতর্কতা আসলে ছিল একটি প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকা।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি-
ইসলামে রাতের অন্ধকারে একা বড় গাছের তলায় না থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা মানুষের শারীরিক সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত। হিন্দু সংস্কৃতিতে বটগাছকে দেবত্বের প্রতীক মনে করা হলেও, রাতে এর নীচে না বসার উপদেশ ছিল বাস্তব স্বাস্থ্যগত সতর্কতার প্রতিফলন।
লোকবিশ্বাসের আড়ালে প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনযাপনের জন্য গবেষণাহীন কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
উদ্ভিদ কি মানুষের আবেগ বোঝে?
যদিও উদ্ভিদ মানুষের মতো চেতনাশীল নয়, তবে সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে-
উদ্ভিদ স্পর্শ, আলো, শব্দ ও পরিবেশের পরিবর্তন বুঝে সাড়া দেয়। গবেষণায় এমনও প্রমাণ পাওয়া গেছে, গাছ কেটে ফেলার সময় তারা উচ্চ-কম্পাঙ্কের শব্দ সৃষ্টি করে, যা মানুষের কানে শোনা যায় না।
অনেক বিজ্ঞানী এটিকে উদ্ভিদের "স্ট্রেস সিগন্যাল" হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে এখনো স্পষ্টভাবে বলা যায় না যে উদ্ভিদ মানুষের আবেগ বোঝে কিনা, তবে তারা নিঃসন্দেহে পরিবেশের সূক্ষ্ম পরিবর্তন অনুভব করে।
কেন এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ?
জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় আর পরিবেশ দূষণের যুগে এই গবেষণা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। যদি গাছ সত্যিই শব্দ, কম্পন ও পরিবেশের প্রতি এতটা সংবেদনশীল হয়, তবে আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডই প্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলে। লোকবিশ্বাস ও বিজ্ঞানের এই মিল আমাদের জানায়-গাছকে আমরা যতই নিঃশব্দ মনে করি না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের চেয়ে বেশি সজাগ ও সংবেদনশীল।
"গাছের নিচে ঘুমিও না"-এই সতর্কবার্তা একসময় কেবল ধর্মীয় বা পৌরাণিক গল্প মনে হতো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করছে, এর পেছনে বাস্তব কারণ রয়েছে। একইভাবে, উদ্ভিদ যে শব্দ অনুভব করতে পারে সেটিও এখন আর কল্পকাহিনী নয়, বরং গবেষণাভিত্তিক সত্য।
প্রকৃতিকে যত আমরা বুঝব, ততই আবিষ্কার করব-মানুষ ও গাছের সম্পর্ক কেবল ব্যবহার বা উপকারের নয়, বরং গভীর পারস্পরিক সংবেদনশীলতার।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।