মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই!

মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শৈশবের স্মৃতিতে বই মানেই ছিল উচ্ছ্বাস, কৌতূহল আর নতুন জ্ঞানের ঘ্রাণ। স্কুলে নতুন বই হাতে পেলে আমরা প্রথমেই উল্টেপাল্টে দেখতাম, পাতার গন্ধ শুঁকতাম। মা-বাবা তাড়াতাড়ি বাঁধাই করে দিতে বলতেন না হলে বই ছিঁড়ে যাবে। বাঁধাইয়ের উপকরণ হতো পুরোনো ক্যালেন্ডার, মোটা কাগজ কিংবা রঙিন ফাইলপত্র। কিন্তু যদি কেউ বলে বসে "মানুষের চামড়া দিয়েও বই বাঁধানো হয়েছে" তাহলে কি বিশ্বাস করবেন? অদ্ভুত শোনালেও ইতিহাস বলছে, এমন বই বাস্তবেই আছে। আর এই ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়ার নাম হলো অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি (Anthropodermic Bibliopegy)।

শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে "অ্যান্থ্রোপোস" অর্থাৎ মানুষ, আর "ডার্মা" মানে চামড়া। অন্যদিকে "বিবলিওপেজি" এসেছে "বিবলিয়ন" (বই) এবং "পেজিয়া" (বাঁধাই করা) থেকে। অর্থ দাঁড়াচ্ছে মানবচর্মে বাঁধানো বই।

ফরাসি দার্শনিক আর্সেন হুসে লিখেছিলেন Des destinées de l'âme (Destinies of the Soul)। ১৯শ শতকের শেষদিকে বইটির একটি কপি এক চিকিৎসক বন্ধুর হাতে গেলে সেটি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়। পরে এ বইটি সংরক্ষিত ছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউটন লাইব্রেরিতে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার পর এটিই ইতিহাসে প্রথম নথিভুক্ত অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বই হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে নৈতিক বিতর্কের কারণে পরবর্তীতে এর বাঁধাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অনেক বছর ধরে নানা দাবি-গুজব চললেও সাম্প্রতিক সময়ে Peptide Mass Fingerprinting (PMF) এবং MALDI নামের প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচাই করা হয়েছে কোন বাঁধাই সত্যিই মানুষের চামড়ার, আর কোনটি ভেড়া, ছাগল বা হরিণের। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৪৭টি বইয়ের মধ্যে ৩২টি পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মাঝে ১৮টি সত্যিই মানবচর্মে বাঁধানো, বাকিগুলো প্রাণীর চামড়ায়।
 

উল্লেখযোগ্য উদাহরণসমূহ-

◑ জন স্টকটনের সংগ্রহ: মার্কিন চিকিৎসক জন স্টকটন তার কিছু মৃত রোগীর চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই করেছিলেন। এসব বইয়ের কিছু আজও ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।

◑ ব্রিস্টল রেকর্ড অফিস: জন হরউড নামের এক খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর তার কেস-সংক্রান্ত নথি তার নিজের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়। বাঁধাইয়ের কভারে মানুষের খুলি ও হাড়ের নকশা খোদাই করা আছে।

◑ উইলিয়াম বার্কের চামড়া: কুখ্যাত খুনি উইলিয়াম বার্ক ১৮২৯ সালে ফাঁসিতে ঝুলে। মৃত্যুর পর তার চামড়া দিয়ে একটি বই ও পকেটবুক বানানো হয়, যা আজও স্কটল্যান্ডের মিউজিয়ামে প্রদর্শিত।

◑ জেমস অ্যালেনের কাহিনী: মৃত্যুর আগে নিজের অপরাধকাহিনী লিখে রেখে যান অ্যালেন। তার ইচ্ছায় দুটি কপি বই তার চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল—একটি দেওয়া হয়েছিল তার ডাক্তারকে, আরেকটি তাকে একবার প্রতিরোধ করা এক সাহসী নাগরিককে।

◑ Les terres du ciel: ফরাসি জ্যোতির্বিদ ক্যামিল ফ্ল্যামারিওনের লেখা এই বইয়ের এক কপি বাঁধানো হয়েছিল তার এক নারী ভক্তের চামড়া দিয়ে। এটি ১৯শ শতকের অন্যতম অদ্ভুত উদাহরণ।
 

গবেষকদের একটি বিশেষ উদ্যোগ হলো Anthropodermic Book Project। তাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের সব সন্দেহভাজন বই পরীক্ষা করে সত্যতা যাচাই করা। এ পর্যন্ত তারা নিশ্চিত করেছে, কমপক্ষে দেড় ডজন বই সত্যিই মানবচর্মে বাঁধানো।


আজকের দৃষ্টিতে এই প্রথা নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর ও অমানবিক। কখনও মৃতদেহ থেকে অনুমতি ছাড়াই চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে, আবার কখনও অপরাধীর দেহকে "শাস্তির প্রতীক" হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই অমানবিক ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা কতটা নিষ্ঠুর পথে হেঁটে এসেছে। বর্তমানে এসব বই শুধু ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই সংরক্ষিত, যাতে আমরা বুঝতে পারি মানব মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব কতটা। বলা যায়, মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই শুধু বিরল নিদর্শন নয়, বরং মানব সভ্যতার এক বিভৎস শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের নামে কখনোই নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ