দুশ্চিন্তা, চাপ ও অস্থিরতা দূর করতে মাইন্ডফুলনেসের বৈজ্ঞানিক কৌশল

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের তিক্ত গতির জীবনে "চাপ" যেন প্রতিটি নারীর ও পুরুষের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু চাপকে শুধু 'অবস্থা' ধরলে চলবে না—এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তা শরীর ও মনের জটিল জৈব-রসায়ন বদলে দিতে পারে। মাইন্ডফুলনেস (মননশীলতা) এমন এক অনুশীলন, যার কেন্দ্রবিন্দু—বর্তমান মুহূর্তে সম্পূর্ণ উপস্থিত থাকা। পরবর্তী কয়েক শ্লাইনে আমরা সেটা কেন কাজ করে, কীভাবে কাজ করে, এবং দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে গভীরভাবে প্রয়োগ করা যায় - তা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও ব্যবহারিক নির্দেশনা মিলিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।
মাইন্ডফুলনেস মানে আত্মনির্দেশিত, অবিচারহীনভাবে বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দেয়ার অনুশীলন। অতীতের দুশ্চিন্তা বা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আটকে না থেকে "এখুনি" যে অনুভবগুলো হচ্ছে সেগুলোকে শুধু লক্ষ্য করা—এই অনুশীলনের মৌল। এর ফল দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং আবেগগত অস্থিরতা কমে আসে; মনোযোগ ও সিদ্ধান্তগ্রহণে উন্নতি হয়; ঘুমের গুণগত মান বাড়ে; এবং জীবনের স্বাভাবিকতার সঙ্গে পুনরায় সংযোগ গড়ে ওঠে।
যেভাবে কাজ করে -
১। HPA অক্ষ ও কর্টিসল নিয়ন্ত্রণ: চাপের সময় হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল (HPA) অক্ষ সক্রিয় হয়, ফলে কর্টিসল বাড়ে। নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন HPA অক্ষের উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে; ফলে শরীর 'চাপের' অবস্থায় দীর্ঘ সময় আটকে থাকে না।
২। অ্যামিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সম্পর্ক: অ্যামিগডালা ভয় ও উদ্বেগের কেন্দ্র; মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (যা সিদ্ধান্ত, নিজ-নিয়ন্ত্রণ, মনোসংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে)কে শক্তিশালী করে-ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণে উন্নতি ঘটে এবং অতি-তীব্র স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া কমে।
৩। ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (DMN) কম সক্রিয়তা: উদ্বিগ্ন চিন্তা ও মনঘোর দেখাতে DMN বেশি সক্রিয় হয়। মাইন্ডফুল চর্চায় DMN-এর অতিরিক্ত বনাম-চলাচল কমে-অর্থাৎ 'বহুল ভাবনায়' থাকা কমে।
৪। ফিজিওলজিক্যাল মন্থরতা: শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর ও নিয়ন্ত্রিত হলে হৃৎপিন্ডের হার (HR) ও রক্তচাপ স্থিতিশীল থাকে; কিছু গবেষণায় দেখেছে মাইন্ডফুলনেস HRV (হার-রেট ভ্যারিয়েবিলিটি) উন্নত করে, যা ভালো প্যারাসিম্প্যাথেটিক টোনের ইঙ্গিত।
সংক্ষেপে: মননশীলতা কেবল "শান্ত হওয়া" নয়-এটি দেহ ও মস্তিষ্কে পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন আনে, যেগুলো চাপের ঝুঁকি কমায় এবং মেন্টাল ফাংশন উন্নত করে।
যে ধরনের মানসিক সমস্যা মাইন্ডফুলনেসে সহায়তা পেতে পারে-
দৈনন্দিন স্ট্রেস, হালকা থেকে মাঝারি উদ্বেগ, অনিদ্রা সম্পর্কিত কিছু লক্ষণ, ফোকাসের সমস্যা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধায় মাইন্ডফুলনেস প্রমাণিতভাবে লাভজনক। কিন্তু এতে সীমাবদ্ধতা আছে—গভীর ট্রমা, মনস্তাত্ত্বিক গুরুতর সমস্যা (সিউডোসিস/সিভিয়র মেজর ডিপ্রেশন/সুইসাইডাল ভাবনা ইত্যাদি) থাকলে শুধুমাত্র মাইন্ডফুলনেসই যথেষ্ট নাও হতে পারে; সেখানে পরামর্শদাতা বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন।
দৈনন্দিন জীবনে মাইন্ডফুলনেসের ব্যবহার -
☞ মাইন্ডফুল ইটিং: খাওয়ার সময় অ্যালার্ম বন্ধ করে, খাবারের গন্ধ, স্বাদ, টেক্সচার অনুভব করুন।
☞ টেক-ডিটক্স ব্যাবহার: প্রতিদিন ১–২ সময় ছোট 'ডিজিটাল-ব্রেক' নিন—যেখানে ফোন-নাইঙ্গ।
☞ STOP পদ্ধতি (কিছু সেকেন্ডের জন্য): Stop — Take a breath — Observe — Proceed। কাজের চাপ বাড়লে দ্রুত শান্তি আনতে কার্যকর।
☞ মাইন্ডফুল রিলেশনশিপস: কেউ কথা বলার সময় ফোন রেখে পুরোপুরি শুনুন। এতে মনোযোগ বাড়ে, সম্পর্ক উন্নত হয়।
সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা -
⇨ ট্রমা বা PTSS থাকলে: মাইন্ডফুলনেস কখনো কখনো তীব্র আবেগ বা স্মৃতি জাগাতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত থেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে কার্যকর করা উচিত।
⇨ গভীর বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার ভাবনা: একা মাইন্ডফুলনেসে নির্ণয় বা চিকিৎসা বিশ্বাস করবেন না।অবিলম্বে পেশাদার সাহায্য নিন।
⇨ মন-ঘোর/সাইতানী ভাবনা (psychosis) থাকলে: নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অনুশীলন ক্ষতিকর হতে পারে,চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
⇨ শুরুতে অস্বস্তি স্বাভাবিক: প্রথম থেকেই শান্তি না পেলে হতাশভাবে থামবেন না; অনেকের ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক সেশনে অস্বস্তি বা বেশি বৃথা ভাব থাকে, নিয়মিত অল্প সময়েই সুফল দেখা দেয়।
মাইন্ডফুলনেস কোনো আশ্চর্য চিকিত্সা নয়; এটি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক-দেহের প্রতিক্রিয়া বদলে দেয়। এটি সহজ, কম ব্যয়বহুল এবং নিজের জীবনযাত্রায় দ্রুত যোগ করা যায়। কিন্তু ধারাবাহিকতা ও ধৈর্য প্রয়োজন। শুরুতে প্রতিদিন ৫–১০ মিনিটই দ্রুত ফল আনতে পারে; পরে সময় বাড়ালে প্রভাব আরও দৃঢ় হয়। যদি কখনো গাইডেন্স লাগে, স্থানীয় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বা প্রশিক্ষিত মাইন্ডফুলনেস প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিন,বিশেষত যদি আপনি আগেই মানসিক অসুবিধা অনুভব করেন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।