জাবি শিবিরের স্পেশাল কোচিং, মায়ের কান্না ও দুর্ঘটনা—শেষটা মাদ্রাসা হওয়ায় ভাইভা থেকে বাদ

জাবি শিবিরের স্পেশাল কোচিং, মায়ের কান্না ও দুর্ঘটনা—শেষটা মাদ্রাসা হওয়ায় ভাইভা থেকে বাদ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

জাবি শিবিরের স্পেশাল কোচিং, মায়ের কান্না ও দুর্ঘটনার গল্প শেষ হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় ভাইভা থেকে বাদ পড়ার ঘটনায়। ভর্তি পরীক্ষায় বৈষম্য ও শিক্ষার্থীদের হতাশা বাড়িয়েছে এ ঘটনা। জানুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির বিতর্ক, কোচিং সিন্ডিকেট ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়নের বাস্তব চিত্র। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক ফেসবুক পোস্টে জাবির ভর্তি প্রক্রিয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি। তবে কার গল্প শেয়ার করেছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি তিনি।

ফেসবুক পোস্টে সিবগা লেখেন, অজপাড়াগাঁয়ের একজন গল্পটা বললেন, ছেলেটির গল্প আপনাকে সংযুক্ত করবে কিনা, জানি না জাহাঙ্গীরনগরের বিজয়ের খবরে (জাকসুতে শিবিরের প্যানেলের জয়ী) জীবনের নির্মম এক ইতিহাসের কথা মনে পড়ল।

তিনি ছিলেন আমার জেলার বাছাইকৃত সাথী। যাকে জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি কোচিংয়ের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে আমি দাখিলে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ২০০৮ সালে আলিম পরীক্ষা শেষ হতেই ডাক এল সংগঠনের। গ্রাম ছাড়তে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোচিং করতে হবে। কিন্তু নরমাল কোনো কোচিং নয়। স্পেশাল কোচিং। সেদিন ছিল, ভয়াবহ কালবৈশাখের রাত। থানা সভাপতি ফোন দিয়ে বললেন, এই মুহুর্তে আপনাকে থানা অফিসে অফিসে আসতে হবে। কিন্তু মা কোনোভাবেই ঘর থেকে বের হতে দিবেন না এই ঝড়ের রাতে।

মায়ের অবাধ্য হয়ে দায়িত্বশীলের আনুগত্য রক্ষা করতে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ভারি তুফানের মধ্যে ৬ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে থানা অফিসে গিয়ে ভেজা শরীরে হাজির হয়েছেন। গিয়ে দেখলেন জাহাঙ্গীরনগর থেকে ৩ জন ভাই আগেই উপস্থিত। তিনি খুব অবাক হলাম শুধু তার সাথে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল এতো প্রত্যন্ত গ্রামে। তাকে দায়িত্বশীলরা বুঝালেন জাহাঙ্গীরনগরে কেন ভর্তি হওয়া দরকার। একটা কোচিংয়ের কথা জানালেন। বললেন, ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাকে এই ময়দানে বাছাই করা হয়েছে। তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। কিন্তু ভর্তি হতে যে টাকার প্রয়োজন, সেই টাকা তার কাছে ছিল না।

অজপাড়াগাঁয়ের সেই ছেলেটির বকি গল্পটা শুনুন সিবগাতুল্লাহ সিবগার স্ট্যাটাস থেকে...

মাকে নিয়ে ঢাকায় আসলাম। মা আমাকে নিয়ে মামার কাছে গেলেন। মামা বিরাট শিল্পপতি। কয়েকটা ফ্যাক্টরির মালিক। মামা কোনোভাবে আমাকে পড়াশোনা করানোর জন্য রাজি হলেন না। তখন শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন আমার জেলার। আমি তার সাথে দেখা করলাম। উনি ইসলামি ব্যাংক থেকে ৫ হাজার টাকার অনুদান নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জাহাঙ্গীরনগরের কোচিংয়ে।
 
এক অন্যরকম পরিবেশ। সারাদিন শুধু পড়ালেখা, নামাজ, পরীক্ষা, ৩ বেলা খাওয়া আর ৫ ঘণ্টা ঘুমান। জানালার পর্দাটাও সরানো নিষেধ ছিল। ফোনে কথা বলা নিষেধ। সারাদিন পড়াশোনার পর রাতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ। হে আল্লাহ, তুমি জাহাঙ্গীরনগরের ময়দানকে ইসলামের জন্য কবুল করো। এবং আমাকে সেই ময়দানের জন্য কবুল করো।

মাস দুয়েক কোচিং করার পর মামা জানতে পেরে যায় আমি শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেলের সহায়তায় কোচিং করছি। মামা ছিলেন প্রচণ্ড শিবির বিদ্বেষী। মামা আমার মাকে হুমকি দিলেন। আমাকে কোচিং থেকে বের করে নিয়ে আসতে বললেন। মামার ফ্যাক্টরিতে চাকরিতে যেতে হবে বলে বাধ্য করলেন। না হলে আমাদের ফ্যামিলিতে আর এক টাকাও দিবেন না। আমার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বলল, তুই আর পড়াশোনা করিস না বাবা। তোর মামার কথা শুন, আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আমার বাবা একজন প্রতিবন্ধী। কোনোমতে সংসার চলছিল মামার সহযোগিতায়। তাই সেদিন পরিবারের জন্য নিজের স্বপ্নের কুরবানি দিয়ে দিই। বাধ্য হয়ে কোচিং ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কোচিংয়ের হাউজ পরিচালককে জানিয়ে দিলাম, পরেরদিন সকালে চলে যাব।

সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাত ১২টার পর গোসল করে তাহাজ্জুতে দাঁড়ালাম। আল্লাহর কাছে উপায় চাইলাম। কান্নাকাটি করলাম। হে আল্লাহ, আমি পড়াশোনা করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই। আমাকে তুমি একটা উপায় দাও। উপায় দাও আল্লাহ। সকালে তো আমাকে চলে যেতে হবে।

ফজর পড়ে কোচিং থেকে বের হলাম। যাওয়ার সময় আমার কোচিংমেটরা আমাকে চোখের পানিতে বিদায় দিলেন। আমার খুব কষ্ট হলো। জিপিএ ফাইভ পাওয়া স্টুডেন্ট হয়ে আমি ফ্যাক্টরির শ্রমিক হতে যাচ্ছি। আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলাম তখন, যখন সারা বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে ১৯ হাজার জন এ+ পেয়েছিলাম। আমি তার মধ্যে একজন। শিবিরের পক্ষ থেকে যে এ+ সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ততকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবির সভাপতি শিশির মুহাম্মদ মুনির। তার বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি শিবিরের কর্মী থেকে সাথী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সাথী হতে ৯ মাস লেগে যায়। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হইলেই বাদ। যাইহোক শিবিরের সাথী শপথ নিলাম। এরমধ্যেই আলীম পরীক্ষা শেষ করে কোচিংয়ে গেলাম। আর এসব পরিস্থিতি মুখোমুখি হলাম। 

যেদিন কোচিং থেকে বের হয়ে যাচ্ছি, ভাবতেছি- আল্লাহ বুঝি আমার দোয়া কবুল করবে না। কিন্তু আমি এটা বুজতেই পারিনি যে, আল্লাহ আমার দোয়া এভাবে কবুল করবেন। আমাকে একটা দুর্ঘটনার মুখোমুখি করে পড়ালেখায় ফেরাবেন। 

মামার ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পথে আমি মারাত্মকভাবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হই। আমার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। আমাকে মানুষ ফুটপাতে শোয়াই রাখলেন। বাম হাত দিয়ে মোবাইল বের করে একজনকে বললাম, আমার কোচিংয়ের এক বন্ধুকে ফোন করতে৷ ফোন করা হলো। সেও আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি শাকিল উদ্দিন ভাই কোচিংয়ে হাজির হলেন, সবাইকে হলরুমে ডাকলেন। পরে জানতে পারলাম, আমি বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরে তিনি কোচিংয়ে গিয়েছেন। অফিসকক্ষে একটু ঘুমালেন। ঘুম থেকে উঠে অনেকটা খালি গায়ে সেন্টু গেঞ্জি পরা অবস্থায় হলরুমে দৌড়ে এলেন। দায়িত্বশীলদের বললেন, সবাইকে ডাকতে। এরমধ্যে যেই ছেলেটা আমাকে উদ্ধারের জন্য বের হচ্ছিল সেও আটকা পড়লো শাকিল ভাইয়ের কারণে।

সবাই অবাক সেন্টু গেঞ্জি পরা শাকিল ভাই, একজন শাখা সভাপতি- এই অবস্থায় কেন বৈঠক ডাকলেন। শাকিল ভাই তার বক্তব্য শুরু করলেন। বললেন, আমি একটা ছেলেকে খুজছি। পাচ্ছি না। সবাই জিজ্ঞেস করলো কাকে? শাকিল ভাই বললেন, "আমি ছেলেটার নাম জানিনা। তবে এখানে এসে অফিস রুমে ঘুমানোর পর স্বপ্নে দেখলাম, একটা ছেলে কোচিং থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, আমাকে দেখে ডান হাত লুকিয়ে ফেললো। এরপর ঘুম ভেঙে যায়"। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। যে আমাকে উদ্ধারের জন্য রওনা হচ্ছিল- সে দাড়িয়ে বললো, ভাইয়া আমাদের এক কোচিংমেট পারিবারিক কারণে কোচিং থেকে সকালে বের হয়ে গেছে। যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট হয়ে তার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। এটা শুনে শাকিল ভাই চিতকার দিয়ে উঠলো। হে আল্লাহ, আমার স্বপ্নের সাথে মিলে গেলো। 

শাকিল ভাই হাউজ পরিচালককে বললেন,  আপনি ওকে যেতে দিলেন কার অনুমতি নিয়ে, ওকে সেক্রেটারি জেনারেল পাঠিয়েছে। শাকিল ভাই আমাকে উদ্ধারের জন্য লোক পাঠালেন।  আমার চিকিৎসা করালেন। আমাকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন। আসার পথে কোচিংয়ে নিয়ে আসলেন। বললেন, তোমার কোনো টাকা পয়সা লাগবে না। সব ফ্রী। তুমি কোচিং করো।

আমি আবার কোচিং শুরু করলাম। আমার এক্সিডেন্টের খবর শুনে মামাও কিছুটা নরমাল হলেন। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। আল্লাহ আমাকে ফিরিয়েছেন। কোচিংয়ের সাপ্তাহিক পরীক্ষা সবাই লিখিত দিত। আমার যেহেতু ভাঙ্গা হাত, আমি মুখে পড়া বলতাম। আমার পরীক্ষা মৌখিক হতো। কোচিংয়ে এমন অনেকেই ছিলেন। যাদের সিদ্ধান্ত ছিল, জাহাঙ্গীরনগর ছাড়া কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দিবে না। কারণ, জাহাঙ্গীরনগরের ময়দান ছিল শিবিরের জন্য নিষিদ্ধ। পরীক্ষার আগে আল্লাহর রহমতে আমার হাত ভালো হয়ে গেলো। আমি ফিলোসোফিতে ১৯তম হলাম। যথারীতি ভাইভাতে এটেন্ড করলাম। কিন্তু, ভাইভা বোর্ড থেকে আমাকে বের করে দেয়া হলো। ভাইভা বোর্ডে বলা হলো মাদ্রাসা এবং কারিগরি মিলে একজন নেয়া হবে। আপনার আগে আরও ৪ জন আছে।

যাইহোক আমি ভর্তি হতে পারলাম না। যুগের পর যুগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি এই জুলুম করতো তারা। সেই জাহাঙ্গীরনগরের জন্য সব সময় দোয়া করতাম। আল্লাহ তুমি এই ময়দানকে কবুল করো। আল্লাহ আজকে বিজয় দিলেন। যেই ক্যাম্পাসে শিবিরকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করা, সেখানে শিবিরের ভূমিধস বিজয় হলো। আল্লাহু আকবর। আল্লাহর কাছে হাজার কোটি শুকরিয়া।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ