জীবন বাঁচাতে দেরি নয়! স্তন ক্যান্সার নিয়ে প্রতিটি নারীরই যা জানা দরকার

জীবন বাঁচাতে দেরি নয়! স্তন ক্যান্সার নিয়ে প্রতিটি নারীরই যা  জানা দরকার
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

স্তন ক্যান্সার আজকের বিশ্বে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়া ক্যান্সারগুলোর এক। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর লক্ষ লাখ নারী এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সংখ্যানুযায়ী সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। সচেতনতা ও সময়োপযোগী শনাক্তকরণ না থাকলে এটি নীরবভাবে ছড়িয়ে পড়ে জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে; কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ফলাফল অনেকাংশেই ভালো থাকে।

বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালের GLOBOCAN ও পরবর্তী বিশ্লেষণগুলোতে স্তন ক্যান্সারকে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটতি ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ রোগের নতুন কেস ও মৃত্যুর সংখ্যা ভবিষ্যৎ এও বৃদ্ধি পাবে। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিও এক ভূমিকা রাখে। 

বাংলাদেশে স্তনই নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার সাইট হিসেবে শনাক্ত। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ রোগীই দেরিতে চিকিৎসা নেন, যখন রোগ অনেকটাই জটিল হয়ে যায়, ফলে জীবনহারের ঝুঁকি বাড়ে। স্থানীয় গবেষণাগুলো দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে সচেতনতার অভাব, সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও সেবা-অভিগম্যতার সীমা ইত্যাদি চিহ্নিত করেছে।

স্তন ক্যান্সার বোঝায়-স্তন টিস্যুর কোনও কোষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দ্রুত বিভক্ত হতে শুরু করা। প্রথমে এটি একটি ছোট কর্টেক্স বা উত্থান আকারে থেকে যেতে পারে; যতদিন তা লুকিয়ে থাকে তত সময়ে কোষ আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়, লিম্ফনোড বা রক্তপ্রবাহে ছড়াতে পারে এবং সিস্টেমিক রোগ হিসেবে গড়ে ওঠে। জিনগত অগ্রগতি (যেমন BRCA মা/বাবা থেকে প্রাপ্ত দুর্গুণ), হরমোনে দীর্ঘমেয়াদী এক্সপোজার, এবং পরিবেশগত/আচরণগত কারণ একসঙ্গে কাজ করে কোষকে ক্যান্সারাত্মক রূপ দিতে সাহায্য করে। 

 

ঝুঁকির কারণ -

⇨ জেনেটিক ঝুঁকি (BRCA): BRCA1/BRCA2-এ ক্ষতিকারক পরিবর্তন থাকলে জীবনের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়ে—অনেক সূত্রে এই ঝুঁকি ৫০%-এর উপরে পর্যন্ত দেখানো হয়েছে, তাই পারিবারিক প্যাটার্ন থাকলে জেনেটিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন।

⇨ বয়স ও লিঙ্গ: বয়স বাড়ার সাথে ঝুঁকি বাড়ে; নারীদের ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় বহুগুণ বেশি।

⇨ হরমোন ও প্রজনন ইতিহাস: অল্পবয়সে মাসিক শুরু (early menarche), দেরিতে রেনা (late menopause), প্রথম সন্তান দেরিতে পাওয়া বা সন্তানে অনুপস্থিতি-এসব বৈশ্বিক গবেষণায় ঝুঁকি বাড়ায়।

⇨ অ্যালকোহল ও মোটা হওয়া: প্রতিদিনের মাত্রা কমই হোক, এক গ্লাস দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বাড়ায়—কিছুকিছু বিশ্লেষণে দেখা গেছে দিনে ~এক স্ট্যান্ডার্ড ড্রিঙ্ক পর্যন্তেও ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত ওজন বা কেন্দ্রীয় স্থূলতা বিশেষ করে মেনোপজের পরে ঝুঁকি বাড়ায়।

⇨ শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও খাদ্যাভ্যাস: নিয়মিত অনুশীলন না করলে ঝুঁকি বাড়ে; বিপরীতে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ক্যান্সার ঝুঁকি ও পুনরাবৃত্তি উভয়ই কমায়।

⇨ স্তন ঘনত্ব (Breast density): ঘন স্তন টিস্যু ক্যান্সারের জন্য একটি স্বাধীন ঝুঁকির সূচক এবং ম্যামোগ্রামেও ক্যান্সার লুকিয়ে যেতে পারে। ঘন স্তনের খবর হলে ডাক্তারের সঙ্গে বিকল্প পরীক্ষার কথা ভাবা যেতে পারে। 

 

লক্ষণগুলো -

স্তন ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো-

⇨ স্তনে অনিয়মিত পিণ্ড বা শক্ত উত্থান

⇨ স্তনের আকার/আকৃতিতে ধারাবাহিক পরিবর্তন, ⇨ ত্বকে লালচে বা আঁশযুক্ত পরিবর্তন, স্তনবৃন্ত থেকে ⇨ অস্বাভাবিক নির্গমন (রক্ত বা স্বচ্ছ তরল), 

⇨ স্তনবৃন্ত ভেতরে ধসে পড়া

-এসবের মধ্যে যেকোনো একটি দেখা গেলে দ্রুত ক্লিনিকেই দেখানো উচিত। এগুলো শতভাগ ক্যান্সার নয়, তবে উপেক্ষা করে সমস্যা বাড়লে বিপজ্জনক হতে পারে। 

 

কোন টেস্ট কখন করবেন এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ

⇨ নিজে নিজে (Self-exam) ও ক্লিনিকাল পরীক্ষা: নিয়মিত আত্মপরীক্ষা সচেতনতা বাড়ায়; ক্লিনিকাল বারে-বার করা হলে ডাক্তার প্রথম ধাপটায় সন্দেহ ধরতে পারবেন।
 

⇨ ম্যামোগ্রাম (মুক্তভাবে বলা হয় স্তনের এক্স-রে): সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত স্ক্রিনিং টুল; বিভিন্ন গ্রুপের সুপারিশে পার্থক্য আছে—কিছু শক্তিশালী পরামর্শ দেয় যে ৪০–৭৪ বছর পর্যন্ত দুইবছর অন্তর বহুল সুবিধা আছে, আবার অন্য সংস্থাগুলো ৪০–৪৪ এ বছরে শুরু করে বছরিক অথবা ৪৫–৫৪ বছরে বছরিক, ৫৫+ এ দ্বিবার্ষিক টেস্টের কথা বলে। ফলে কবে এবং কত ঘনভাবে স্ক্রিনিং করবেন—ডাক্তারের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝুঁকি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। 


⇨ অল্ট্রাসাউন্ড ও এমআরআই: বিশেষত যুবতী বা ঘন স্তন টিস্যু থাকা অবস্থায় ম্যামোগ্রামের পাশাপাশি বা সন্দেহজনক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
 

⇨ বায়োপসি ও টিস্যু-পর্যায়ন: সন্দেহজনক কোনো আঘাত, ইমেজিং বা ধারাবাহিক পরিবর্তন থাকলে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষাই নিশ্চিত করে। এছাড়া টিউমারের রিসেপটর স্ট্যাটাস (ER/PR/HER2) নির্ধারণ করলে চিকিৎসার দিশা বদলে যায়—এটাই আজকের রোগ ব্যবস্থাপনার মেরুদণ্ড। 

 

নতুন পরীক্ষণ-চিকিৎসা: 

গত কয়েক বছরে HER2-low-এর জন্য নতুন ADC ড্রাগ (যেমন trastuzumab-deruxtecan/Enhertu) ও CDK4/6 ইনহিবিটর-ভিত্তিক কেমোবাহিত থেরাপিগুলি কিছু রোগীর জন্য বড় সুবিধা নিয়ে এসেছে।  তবে এগুলো উচ্চমূল্যের ও বিশেষ কেন্দ্রে সাধারণত উপলব্ধ। উন্নত থেরাপি মানেই সার্বজনীন প্রবেশাধিকার–এ বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। 
 

প্রতিরোধ :

◑ অ্যালকোহল সীমিত করুন: গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন হালকা থেকে মাঝারি অ্যালকোহলই ঝুঁকি বাড়ায়; যত কম তত ভালো। 


◑ ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম: বিশেষত মেনোপজের পরে অতিরিক্ত ওজন ঝুঁকি বাড়ায়; নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ কেবল প্রতিরোধেই নয়, রিকভারি ও পুনরাবৃত্তি-হ্রাসেও সহায়ক। কিছু বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছে ব্যায়াম ও শারীরিক সক্রিয়তা ক্যান্সার ঝুঁকি ১০–২৫% পর্যন্ত কমাতে পারে।


◑ জেনেটিক কাউন্সেলিং প্রয়োজনে: পরিবারের মধ্যে কেস থাকলে জেনেটিক পরীক্ষা এবং পরামর্শ নেওয়া উচিত—এতে বিশেষ রোধক ব্যবস্থা (জরিপি স্ক্রিনিং, প্রিফারেন্স) আলোচনা করা যায়। 


◑ দাওয়াই-শ্রেণির ব্যাপারে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত: সাধারণ ঝুঁকিতে রোধক ওষুধ (ট্যামক্সিফেন/রালোক্সিফেন) রুটিনে দেওয়া হয় না—বিশেষ উচ্চ-ঝুঁকিতে খণ্ডিত সিদ্ধান্তে বিবেচনা করা হয় (USPSTF-এর দিকনির্দেশিত নীতিগত ব্যাখ্যা আছে)। 

 

বাংলাদেশের বাস্তবতা: বিলম্ব কেন, ও কী করণীয়?

স্থানীয় গবেষণাগুলো বারবার দেখিয়েছে,স্তন ক্যান্সারে রোগীরা অনেক সময় লক্ষণ দেখা দেবার পরও সামাজিক কারণে বা আর্থিক/সেবা-অভিগম্যতার কারণে দেরিতে আসে; ফলে উন্নত পর্যায়ে রোগ ধরা পড়ে ও রোগীর জীবনমান ও টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। দেশের সিস্টেমে স্ক্রিনিং ও হাসপাতাল-কেন্দ্রীয় কেয়ারের সমতা তৈরি না হওয়ায় এটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। জনগণকে সচেতন করা, প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষিত করা এবং স্ক্রিনিং-ক্লিনিক সহজলভ্য করা—এসবই প্রথম ধাপ। 

মাসে একবার নিজের স্তনকে পর্যবেক্ষণ করুন পিণ্ড, ত্বকের পরিবর্তন, নিঃসরণ লক্ষ্য করুন। ৪০ বা তার বেশি হলে এবং/অথবা পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ডাক্তারের সঙ্গে স্ক্রিনিং ক্যালেন্ডার ঠিক করুন (ম্যামোগ্রাম/ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা)। 

যেকোনো সন্দেহ হলে দেরি করবেন না শুরুতেই বায়োপসি ও টিস্যু-রিপোর্ট সিদ্ধান্তকে স্পষ্ট করে দেয়। জীবনযাপন বদলে ঝুঁকি কমান: অ্যালকোহল কমান, নিয়মিত হাঁটা/ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ত্যাগের চেষ্টা করুন। 

স্তন ক্যান্সার ভয় পাওয়ার নয়, সচেতন হওয়ার বিষয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে তা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তাই প্রয়োজন নিয়মিত স্ক্রিনিং, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সবার জন্য সমতাভিত্তিক চিকিৎসার সুযোগ। সময়মতো পদক্ষেপই পারে মৃত্যুহার কমাতে এবং অসংখ্য জীবন বাঁচাতে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ