জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন রোগের প্রকোপ: ক্রমশ বাড়ছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন রোগের প্রকোপ: ক্রমশ বাড়ছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

জলবায়ু পরিবর্তন কেবল প্রকৃতি ও পরিবেশকেই বদলে দিচ্ছে না, এর গভীর প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও। গবেষণা বলছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া, বৃষ্টিপাতের অনিয়ম, এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেক পুরনো রোগ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নতুন সংক্রমণের ঝুঁকি। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগগুলো এখন আর নির্দিষ্ট মৌসুম বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেগুলো দ্রুত নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

জীবাণুবাহী প্রাণী যেমন মশা, টিক (আঁঠাল পোকা), মাছি বা ইঁদুর-এদের জীবনচক্র অনেকাংশেই আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়লে এরা সহজে বেঁচে থাকে, দ্রুত প্রজনন করে এবং দীর্ঘ সময় জীবাণু বহন করতে পারে।
যেমন - গড় তাপমাত্রা বাড়ার ফলে এডিস মশা আরও বেশি সময় সক্রিয় থাকে, ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। আবার অনিয়মিত ও অতিবৃষ্টি জমে থাকা পানিকে মশার বংশবিস্তারের অনুকূল ক্ষেত্র বানায়। তাছাড়া উষ্ণতা বাড়ায় টিক দ্রুত বংশবিস্তার করছে, যা লাইম ডিজিজের মতো নতুন রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করছে।
 

ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার অভিযোজন ক্ষমতা-

প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াও নিজেদের বদলে নিচ্ছে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন এদের জিনগত বৈশিষ্ট্যে প্রভাব ফেলতে পারে, যা তাদেরকে আরও শক্তিশালী ও প্রতিরোধক্ষম করে তোলে। এর ফলে আগে নিয়ন্ত্রণে থাকা রোগগুলো আবারও জটিল হয়ে উঠতে পারে, এবং নতুন সংক্রমণের পথ খুলে দেয়।
 

চরম আবহাওয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষয়-

ঘন ঘন বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড় কেবল মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করছে না, বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল করে দিচ্ছে। বন্যার পর জমে থাকা পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ জলবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, টাইফয়েড বা হেপাটাইটিস ছড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে খরার সময় অপুষ্টি ও মানসিক চাপ মানুষকে আরও দুর্বল করে তোলে।

 

নগরায়ন ও জনস্বাস্থ্য সংকট-

অপরিকল্পিত নগরায়ন, অপ্রস্তুত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অতিরিক্ত জনঘনত্ব মশার প্রজননক্ষেত্রকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরগুলোতে যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সীমিত, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রোগের প্রভাব আরও তীব্রভাবে পড়ছে।

আগে মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং এমনকি আমেরিকার কিছু অংশেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। একইভাবে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় নতুন এলাকায় ছড়াচ্ছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আবার বাড়ছে, বিশেষত যেখানে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে নতুন জলাভূমি তৈরি হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অপুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় যক্ষ্মার ঝুঁকি আবার বাড়ছে।
 

শুধু শারীরিক নয়, জলবায়ু পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বড় প্রভাব ফেলছে। খরা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জীবিকা হারানো, বাসস্থান ধ্বংস হওয়া বা প্রিয়জন হারানোর শোক মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক ব্যাধির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

 

সমাধানের পথ-

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।

⇨ প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান: গাছ লাগানো, জলাধার পুনর্গঠন ও পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা।

⇨ স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণকে রোগ প্রতিরোধের উপায় শেখানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দেওয়া।

⇨ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সীমান্ত পেরিয়ে রোগ ছড়িয়ে পড়ায় বৈশ্বিকভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া।

⇨ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ: নতুন রোগের গতিবিধি বোঝা এবং দ্রুত প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর কেবল ভবিষ্যতের হুমকি নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। মশাবাহিত রোগ থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির মতো বহুমুখী সমস্যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য আজ বিপর্যস্ত। তাই এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সচেতনতা, বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা—অন্যথায় নতুন রোগের প্রকোপ আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ