মিশর পিরামিডের অমীমাংসিত গোপন ইতিহাসের পর্দাফাঁস!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মিশরের মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিড শুধু প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, বরং মানব ইতিহাসের প্রকৌশল, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সমাজ সংগঠনের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ৪৫০০ বছর আগে নির্মিত এই বিশাল কাঠামো আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও রহস্যের জট ছাড়াতে পারেনি।
বিশাল পাথরখণ্ডের ব্যবহার ও পরিবহন রহস্য:
গিজার গ্রেট পিরামিড নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল প্রায় ২৩ লাখ পাথরের ব্লক। প্রতিটি ব্লকের গড় ওজন ২.৫ টন হলেও কিছু গ্রানাইট ব্লকের ওজন ৬০ টনেরও বেশি ছিল। এই গ্রানাইট ব্লকগুলো আনা হয়েছিল আসওয়ান থেকে, যা প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে।
প্রশ্ন জাগে-প্রাচীন মিশরীয়রা কীভাবে এত ভারী পাথর মরুভূমি ও নদীপথ অতিক্রম করে পরিবহন করেছিল?
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পাথর বহনের জন্য কাঠের স্লেজ ব্যবহার করা হতো এবং স্লেজ টানার সময় বালিতে পানি ছিটিয়ে দিলে ঘর্ষণ শক্তি কমে যেত। এতে শ্রমিকদের জন্য ভারী ব্লক টানা তুলনামূলকভাবে সহজ হতো। নর্থ ক্যারোলাইনা উইলমিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পিরামিড নির্মাণের স্থানের পাশে নীল নদের একটি প্রাচীন শাখা প্রবাহিত হতো। ফলে নৌপথে বিশাল পাথর আনা সম্ভব হতো, যা পরিবহন ব্যবস্থার রহস্য আরও কিছুটা উন্মোচন করেছে।
প্রাচীন প্রকৌশল সরঞ্জাম ও নির্মাণ কৌশল:
আধুনিক লেজার ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করেও যে নির্ভুলতা আমরা দেখি, সেই কাজ প্রাচীন মিশরীয়রা করেছিলেন মাত্র কয়েকটি সরল যন্ত্র দিয়ে।
◑ কিউবিট রড: দৈর্ঘ্য মাপার জন্য ব্যবহৃত একটি দণ্ড।
◑ বর্গাকার স্তর: অনুভূমিক পৃষ্ঠ সমতল করার জন্য।
◑ ৩:৪:৫ অনুপাতের ফ্রেম: নিখুঁত সমকোণ (৯০°) তৈরি করতে ব্যবহৃত।
পিরামিডের প্রতিটি দিক পৃথিবীর মূল দিকের (উত্তর-দক্ষিণ-পুর্ব-পশ্চিম) সঙ্গে এতটাই নিখুঁতভাবে মিলে যায় যে, ত্রুটি মাত্র এক ডিগ্রিরও কম। আধুনিক সার্ভেয়িং প্রযুক্তি ছাড়া এমন কীর্তি কীভাবে সম্ভব হলো—এখনও বিজ্ঞানীরা ভেবে পান না।
জ্যামিতি, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের রহস্য:
পিরামিডের মাপজোকে এমন কিছু গাণিতিক ধ্রুবক মিলে যায় যা অবাক করে দেয়—
উচ্চতা ও ভূমির পরিধির অনুপাত প্রায় পাই (π)-এর সমান। এর ঢালের অনুপাত প্রায় গোল্ডেন রেশিও (φ)-এর কাছাকাছি। পিরামিডের চার দিকের অবস্থান সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গবেষকরা মনে করেন, এটি শুধু সমাধি নয়, বরং এক বিশাল জ্যোতির্বিদ্যাগত মানচিত্রও ছিল। পিরামিডের অভ্যন্তরের পথ ও কক্ষগুলোর বিন্যাস নির্দিষ্ট নক্ষত্রের (যেমন—ওরায়ন নক্ষত্রমণ্ডল) সঙ্গে মিলে যায়। এটি প্রমাণ করে, প্রাচীন মিশরীয়দের জ্যোতির্বিজ্ঞান জ্ঞান ছিল অত্যন্ত উন্নত।
অভ্যন্তরের প্রকৌশল (তাপমাত্রা ও স্থিতিশীলতা):
পিরামিডের ভেতরে সারা বছর প্রায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বজায় থাকে, বাইরের প্রচণ্ড গরম কিংবা শীতল আবহাওয়া যাই থাকুক না কেন। আধুনিক গবেষকরা এটিকে "প্রাকৃতিক ক্লাইমেট কন্ট্রোল" বলে অভিহিত করেন।
অন্যদিকে, এর ত্রিভুজাকৃতির নকশা ও বিশাল ওজনের সুষম বণ্টন পিরামিডকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করে তুলেছে। হাজার বছর কেটে গেলেও গিজার পিরামিডগুলো অটল দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অনেক আধুনিক স্থাপনা সময়ের আঘাতে ভেঙে পড়েছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য: মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, ফারাওরা মৃত্যুর পর দেবতাদের জগতে যাবেন। পিরামিড ছিল তাদের জন্য সেই "দিব্য সিঁড়ি"। তাই এর ভেতরে রাখা হতো সোনা, রূপা, অলঙ্কার এবং খাবার, যা ফারাওদের পরকালে প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হতো। একইসঙ্গে, পিরামিডের স্থাপত্য এমনভাবে পরিকল্পনা করা হতো যেন তা ডাকাতদের হাত থেকে ধনসম্পদ রক্ষা করতে পারে।
মিশরের পিরামিড শুধু একটি স্থাপত্য নয়, বরং মানব সভ্যতার সৃজনশীলতা, শ্রম এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এক চূড়ান্ত নিদর্শন। হাজার বছর পরও এগুলো আমাদের শেখায়—মানুষ যখন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, জ্ঞান এবং দক্ষতা কাজে লাগায়, তখন অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলতে পারে। আর সেই কারণেই পিরামিড আজও দাঁড়িয়ে আছে মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন ধাঁধা হয়ে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।