আসক্তির ফাঁদে আপনিও পড়ছেন না তো ? সাবস্ট্যান্স ইউজ ডিসঅর্ডার নিয়ে অজানা কিছু সত্য!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আধুনিক সমাজে সবচেয়ে আলোচিত ও ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাবস্ট্যান্স ইউজ ডিসঅর্ডার (Substance Use Disorder – SUD)। এটি কেবল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংকট নয়, বরং পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী মস্তিষ্কভিত্তিক ব্যাধি, যেখানে মানুষ ক্ষতিকারক পরিণতি জেনেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পদার্থ (যেমন অ্যালকোহল, নিকোটিন, গাঁজা, হেরোইন, কোকেইন, বা প্রেসক্রিপশন ওষুধ) ব্যবহার চালিয়ে যায়।
মানব মস্তিষ্কে একটি "রিওয়ার্ড সার্কিট" রয়েছে, যা ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি তৈরি করে। মাদক বা আসক্তিকর পদার্থগুলো সরাসরি এই সার্কিটকে উদ্দীপিত করে, স্বাভাবিক আনন্দের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়।
ফলাফল হলো -
⇨ মস্তিষ্ক প্রাকৃতিক আনন্দদায়ক কার্যকলাপ (খেলাধুলা, সঙ্গীত, সামাজিকতা) থেকে ধীরে ধীরে আগ্রহ হারায়।
⇨ ব্যবহারকারী মনে করেন, ওই পদার্থ ছাড়া সুখ বা স্বাভাবিক অনুভূতি সম্ভব নয়।
⇨ দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে, যা ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন করে তোলে।
লক্ষণ ও আচরণগত পরিবর্তন
১. অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা (Craving): পদার্থ ব্যবহারের তীব্র মানসিক ও শারীরিক তাগিদ।
২. নিয়ন্ত্রণ হারানো: পরিকল্পনার চেয়ে বেশি বা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার।
৩. বারবার ব্যর্থ চেষ্টা: ব্যবহার কমানো বা বন্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া।
৪. অতিরিক্ত সময় ব্যয়: পদার্থ সংগ্রহ, ব্যবহার এবং এর প্রভাব কাটাতে সময় নষ্ট।
৫. দায়িত্বহীনতা: কাজ, পড়াশোনা বা পরিবারে ভূমিকা অবহেলা।
৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: আগ্রহ হারানো, বন্ধু ও পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া।
৭. ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ব্যবহার: গাড়ি চালানো বা বিপজ্জনক পরিবেশে মাদক গ্রহণ।
৮. শারীরিক উপসর্গ: উইথড্রয়াল হলে কম্পন, মাথা ঘোরা, উদ্বেগ, অনিদ্রা, ঘাম হওয়া ইত্যাদি।
কারণ ও ঝুঁকির উপাদান
⇨ জেনেটিক প্রভাব: পরিবারের ইতিহাস থাকলে আসক্তির সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়।
⇨ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: উদ্বেগ, হতাশা, ট্রমা বা PTSD আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
⇨ সামাজিক পরিবেশ: সহজলভ্যতা, সহপাঠীদের চাপ, পারিবারিক অবহেলা আসক্তি বাড়ায়।
⇨ অর্থনৈতিক প্রভাব: বেকারত্ব বা দারিদ্র্য আসক্তির হার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
⇨ কিশোর বয়স: কৈশোরে মস্তিষ্কের বিকাশ অসম্পূর্ণ থাকে, ফলে আসক্তির ঝুঁকি বেশি।
বৈশ্বিক ও বস্থানীয় প্রভা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ মাদকাসক্তির কারণে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। বিশ্বব্যাপী অ্যালকোহল-সম্পর্কিত কারণে বছরে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়।
দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, ইয়াবা ও হেরোইনের ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসক্তির কারণে কেবল স্বাস্থ্য খাত নয়, আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক কাঠামোতেও প্রভাব পড়ছে।
চিকিৎসা ও পুনর্বাসন: সাবস্ট্যান্স ইউজ ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা বহুমাত্রিক এবং ধাপে ধাপে করা হয়—
১. ডিটক্সিফিকেশন (Detox): শরীর থেকে পদার্থ বের করে আনা; এতে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ জরুরি।
২. ঔষধ-সহায়ক চিকিৎসা (Medication Assisted Treatment): হেরোইন আসক্তির জন্য মেথাডোন বা বুপ্রেনরফিন। অ্যালকোহল আসক্তির জন্য নালট্রেক্সন বা অ্যামপ্রোসেট।
৩. মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা:
◑ কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): চিন্তাধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে আসক্তি নিয়ন্ত্রণ।
◑ মোটিভেশনাল ইন্টারভিউ (MI): রোগীকে চিকিৎসায় আগ্রহী করা।
৪. সাপোর্ট গ্রুপ: "১২-স্টেপ প্রোগ্রাম" বা সমমনা গোষ্ঠী আসক্তি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫. সামাজিক পুনর্বাসন: পরিবার ও সমাজে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
⇨পরিবারে খোলামেলা আলোচনা ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা।
⇨ স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা।
⇨ সমাজে আসক্তিকে "অপরাধ" নয়, বরং "স্বাস্থ্য সমস্যা" হিসেবে দেখা।
⇨ সরকারি পর্যায়ে আসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র বৃদ্ধি ও সহজলভ্য করা।
সাবস্ট্যান্স ইউজ ডিসঅর্ডার একটি বহুমাত্রিক সংকট—এটি চিকিৎসা, মনস্তত্ত্ব, সামাজিক কাঠামো ও নীতিনির্ধারণের সমন্বয়ে মোকাবিলা করতে হবে। এটি কারও দুর্বলতা নয়, বরং একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ব্যাধি। সহানুভূতি, সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে যে কেউ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।