'শ্বেতদ্রোণ': প্রাচীন ঔষধি উদ্ভিদের বিলুপ্তির শঙ্কা

'শ্বেতদ্রোণ': প্রাচীন ঔষধি উদ্ভিদের বিলুপ্তির শঙ্কা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শ্বেতদ্রোণ, যা দণ্ডকলস বা মধু গাছ নামেও পরিচিত, প্রাচীনকাল থেকেই ঔষধি গুণের জন্য ব্যবহৃত। এই গাছের পাতার রস, ফুল ও ছাল বহু রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে। জ্বর, সর্দি, কাশি, কৃমি, পেটফাঁপা, ত্বকের সংক্রমণ এবং নারীদের মাসিকের অতিরিক্ত রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে এটি অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া পোকামাকড়, সাপ বা বিছার কামড়ে ক্ষত নিরাময়েও শ্বেতদ্রোণের ভূমিকা সুপরিচিত। কিন্তু আধুনিক সময়ে, এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ-

১. ভূমির বহুল ব্যবহার ও নগরায়ণ:
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। রাস্তা, শিল্পাঞ্চল, আবাসন এবং কৃষিজমির জন্য পাহাড়ি জমি ও ঝোপঝাড় ধ্বংস হচ্ছে। ফলে শ্বেতদ্রোণের জন্ম ও বৃদ্ধির স্থান সংকুচিত হচ্ছে।

২. অজ্ঞতা ও অবহেলা: শ্বেতদ্রোণ ঔষধি গাছ হলেও সাধারণ মানুষ অনেক সময় এর গুরুত্ব বোঝে না। অনেকেই এটিকে সাধারণ বা অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদ হিসেবে উপেক্ষা করে। এর ফলে গাছ সংরক্ষণে সচেতনতা কম।

৩. প্রাকৃতিক উৎসের ক্ষয়: শ্বেতদ্রোণ মূলত রাস্তার পাশে, পতিত জমি বা ঝোপঝাড়ে জন্মাত। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক স্থান ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নতুন বীজ উৎপাদন ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ কমছে।

৪. পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা: রাসায়নিক সার, শিল্প ধুলো, যানবাহনের বায়ুদূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে। আধুনিক নগরায়ণ প্রাকৃতিক আলো, মাটি ও আর্দ্রতার ভারসাম্য নষ্ট করছে, যা শ্বেতদ্রোণের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক প্রভাব: ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা খরার প্রভাবে শ্বেতদ্রোণের বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধির হার কমছে।

৬. সংগ্রহ ও বাণিজ্যিক চাপ: বিভিন্ন স্থানে লোকাল চাহিদা এবং ঔষধি ব্যবসার কারণে অতিরিক্ত সংগ্রহ হচ্ছে। এটি প্রাকৃতিক জনসংখ্যার হ্রাস ঘটাচ্ছে এবং নতুন গাছ জন্মানোর সুযোগ কমাচ্ছে।
 

ঔষধি গুণাবলী:
শ্বেতদ্রোণ শুধুই ঔষধি উদ্ভিদ নয়; এটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বহুমূল্য:

◑  প্রদাহ ও সংক্রমণ প্রতিরোধ: জ্বর, সর্দি, কাশি ও পেটফাঁপা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

◑ ত্বকের যত্ন: ফাঙ্গাস, র‍্যাশ ও অ্যালার্জি কমাতে কার্যকর।

◑ বিষ বা কামড় প্রতিকার: পোকামাকড়, সাপ বা বিছার কামড়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত।

◑ নারীদের স্বাস্থ্য: মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

◑ পরিবেশগত ভূমিকা: মাটির উর্বরতা বজায় রাখা, ক্ষয়রোধ, স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ।

শ্বেতদ্রোণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি মাটি ধরে রাখে, বায়ু দূষণ কমায় এবং অন্যান্য স্থানীয় উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।

 

সংরক্ষণ ও গুরুত্ব:
শ্বেতদ্রোণ হারালে শুধু ঔষধি গাছ হারাবে না; প্রাকৃতিক ভেষজ চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

⇨জনসচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষকে উদ্ভিদের ঔষধি গুণাবলী ও সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝানো জরুরি।

⇨ সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ: স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওদের মাধ্যমে গাছের রোপণ, বীজ সংরক্ষণ এবং যত্নমূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।

⇨আইনি ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা: অতিরিক্ত সংগ্রহ, অবৈধ কাটাছাঁট ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

⇨ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার: উদ্ভিদ চাষ, বীজ সংরক্ষণ ও পরিবেশ মনিটরিংয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।

 

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

☞ গাছের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ: পতিত জমি ও খোলা মাঠে রোপণ কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।

☞ শিক্ষা ও জনসচেতনতা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রচার মাধ্যমে উদ্ভিদের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে জানানো।

☞ বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা: গাছের ঔষধি গুণাবলী ও বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ার উপর গবেষণা করা।

☞ সামাজিক অংশগ্রহণ: স্থানীয় সমাজ ও সম্প্রদায়কে উদ্ভিদ রক্ষায় সম্পৃক্ত করা।
 

শ্বেতদ্রোণ হারানো মানে মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক ঔষধি সম্পদ এবং পরিবেশের ভারসাম্য হারানো। এটি শুধু গাছ নয়-একটি প্রাচীন ঔষধি ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসার অংশ। আমাদের উচিত এই গাছের সংরক্ষণ, সচেতনতা ও গবেষণার মাধ্যমে প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা।

শ্বেতদ্রোণ শুধু একটি ঔষধি উদ্ভিদ নয়; এটি আমাদের স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এক অমূল্য অংশ। আমরা যদি এই গাছকে রক্ষা না করি, তবে শুধু একটি প্রাচীন ঔষধি হারাবো না-একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য জীবন ও সুস্থতা দান করতে পারতো, সেটাকেও হারাবো। শ্বেতদ্রোণ রক্ষা করা মানে আমাদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করা। এটি হারালে আমাদের জীবন এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ