পার্সোনাল ডেটা বিক্রির অদৃশ্য সাম্রাজ্য: আপনার তথ্য কি সত্যিই ব্যক্তিগত? জানুন কে ব্যবহার করছে এবং কিভাবে!

পার্সোনাল ডেটা বিক্রির অদৃশ্য সাম্রাজ্য: আপনার তথ্য কি সত্যিই ব্যক্তিগত? জানুন কে ব্যবহার করছে এবং কিভাবে!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ডিজিটাল দুনিয়ায় আমাদের প্রতিটি ক্লিক, সার্চ বা কেনাকাটা পরিণত হচ্ছে অদৃশ্য এক পণ্যে যা বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকায়, অথচ আমরা জানিই না সেই ব্যবসার প্রকৃত রূপ।

আজকের পৃথিবীতে তথ্যই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। অর্থ, তেল বা সোনার মতোই এখন তথ্য (Data) এক নতুন ধরনের অর্থনীতির জ্বালানি। আমরা যখন মোবাইল অ্যাপে লগইন করি, ফেসবুকে কিছু লাইক দিই, কিংবা অনলাইনে কিছু কেনাকাটা করি, তখন অজান্তেই আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য এক বিশাল ডেটা বাজারে প্রবাহিত হয়। এই বাজারে লেনদেন হয় কেবল তথ্যের, যেখানে আমরা ক্রেতা নই, বরং পণ্য।
 

ডেটা বাজারের খেলোয়াড় কারা?

১. বিজ্ঞাপন সংস্থা: আপনার আগ্রহ ও আচরণ বিশ্লেষণ করে তারা নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কোনো ওয়েবসাইটে ক্যামেরা খোঁজেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার ফিড ভরে যাবে ক্যামেরার অফার বিজ্ঞাপনে। এভাবেই "টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজিং" নামের এক কৌশল চালিত হয় আপনার তথ্য দিয়ে।
 

২. বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান: তারা কোটি কোটি মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের বাজার সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে। কোন বয়সী মানুষ কোন ব্র্যান্ড পছন্দ করে, কোন শহরে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি। এসব তথ্যের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে ব্যবসায়িক কৌশল।
 

৩. ডেটা ব্রোকার: এরা মূলত তথ্যের মধ্যস্থতাকারী। বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেটিকে শ্রেণিবদ্ধ করে বিক্রি করে দেয়। আপনার বয়স, লিঙ্গ, আয়ের স্তর, ভ্রমণ অভ্যাস এমনকি রাজনৈতিক ঝোঁক পর্যন্ত ডেটা ব্রোকারদের ডাটাবেসে থাকতে পারে। এই ডেটা আবার অন্য কোম্পানি বা রাজনৈতিক প্রচারণা সংস্থার কাছে চলে যায়।
 

৪. প্রযুক্তি কোম্পানি: সার্চ ইঞ্জিন, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ রেকর্ড করে। এর মাধ্যমে তারা ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করে এবং ব্যবসায়িক সুযোগও তৈরি করে।

 

কোথায় ব্যবহার হচ্ছে এই তথ্য?

⇨ ব্যক্তিগতকৃত বিজ্ঞাপন: আপনার অনলাইন আচরণ থেকে তৈরি প্রোফাইল অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখানো হয়।

⇨ অ্যালগরিদম উন্নয়ন: ভিডিও প্ল্যাটফর্মে "আপনার জন্য সাজানো" কনটেন্ট বা ই-কমার্স সাইটে "আপনার জন্য সুপারিশ"—সবকিছুর পেছনে রয়েছে ডেটা।

⇨ বাজার পরিকল্পনা: কোম্পানিগুলো কোন জায়গায় পণ্য চালু করবে, কোন দামে বিক্রি করবে—সবকিছু নির্ধারণ হয় গ্রাহকের ডেটার ভিত্তিতে।

⇨ রাজনৈতিক প্রভাব: অনেক ক্ষেত্রে ভোটারদের মনোভাব প্রভাবিত করতে বা প্রচারণা সাজাতে এই ডেটা ব্যবহার হয়।

⇨ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার: ডেটা যদি ভুল হাতে যায়, তখন তা পরিচয় চুরি, আর্থিক প্রতারণা বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

 

কীভাবে সংগ্রহ করা হয় আমাদের তথ্য?

১. ওয়েব ব্রাউজিং ও কুকিজ: আপনি কোন সাইটে যান, কতক্ষণ থাকেন, কী কী সার্চ করেন—সবকিছু রেকর্ড হয় কুকিজ ও ট্র্যাকিং টুলের মাধ্যমে।

২. সোশ্যাল মিডিয়া কার্যকলাপ: আপনার শেয়ার করা ছবি, স্ট্যাটাস, মন্তব্য, লাইক, এমনকি বন্ধু তালিকার তথ্যও ব্যবহৃত হয়।

৩. মোবাইল অ্যাপস: অনেক অ্যাপ লোকেশন, কন্টাক্ট লিস্ট, মাইক্রোফোন বা ক্যামেরা অ্যাক্সেস নিয়ে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে।

৪. ই-কমার্স ও কেনাকাটার তথ্য: আপনি কী কিনছেন, কোন ব্র্যান্ডে বেশি আগ্রহী—সবকিছুই বাজারে বিক্রিযোগ্য ডেটা।

৫. ডিজিটাল ফাইন্যান্স ও পেমেন্ট ডেটা: আপনার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন লেনদেনের তথ্যও নজর এড়ায় না।

 

কেন এটি বিতর্কিত?

ব্যক্তিগত ডেটা বিক্রির এই ব্যবসা মানুষের গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আপনি হয়তো ভেবেই দেখেননি, কিন্তু আপনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাস্থ্যগত তথ্য বা পারিবারিক সম্পর্কও কোনো এক ডেটা ব্রোকারের তালিকায় থাকতে পারে। এ তথ্য যদি ভুল হাতে যায়, তবে তা ব্যবহার হতে পারে—

◑ প্রতারণামূলক ঋণ বা পরিচয় চুরিতে,

◑ পক্ষপাতমূলক বা বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক প্রচারণায়,

◑ এমনকি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সামাজিক বিভাজন তৈরিতেও।

 

বিশ্বজুড়ে আইনি পদক্ষেপ:

☞ ইউরোপীয় ইউনিয়ন: জিডিপিআর (GDPR) ডেটা সুরক্ষায় কঠোর নিয়ম এনেছে। ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়া ডেটা সংগ্রহ করা আইনত অপরাধ।

☞ যুক্তরাষ্ট্র: বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আলাদা আইন থাকলেও ক্যালিফোর্নিয়ার CCPA আইন ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা দিয়েছে।

☞ বাংলাদেশ: ডিজিটাল সুরক্ষা আইন থাকলেও ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষার নির্দিষ্ট নীতি এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নতির সাথে সাথে ডেটা সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনার চাপ বাড়ছে।
 

ব্যক্তিগত সুরক্ষায় আমরা যা  করতে পারি: 

১।  ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহারের সময় প্রাইভেসি সেটিংস পরীক্ষা করুন।

২। অবিশ্বস্ত অ্যাপকে লোকেশন বা কন্টাক্ট অ্যাক্সেস দেবেন না।

৩। অনলাইনে যেকোনো ফর্ম পূরণের আগে বুঝে নিন, আপনার তথ্য কোথায় ব্যবহৃত হবে।

৪। ভিপিএন বা নিরাপদ ব্রাউজার ব্যবহার করে ট্র্যাকিং এড়ানো সম্ভব।

৫। সবচেয়ে জরুরি বিষয়, সচেতন থাকুন-কারণ আপনার তথ্যই আজকের দিনে আপনার আসল সম্পদ।
 

ডিজিটাল অর্থনীতির এই যুগে তথ্য হলো নতুন "অয়েল"-যা প্রতিদিন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি ডলারের বিনিময়ে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, এই বাজারের সবচেয়ে বড় অংশীদার আমরা, অথচ জানিই না আমাদের তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, তবে এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা তথ্যের ব্যবসা আমাদের গোপনীয়তার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই এখন প্রশ্ন কেবল "আমাদের তথ্য কে কিনছে?" নয়, বরং আরও বড় প্রশ্ন—আমরা কি নিজের তথ্যের প্রকৃত মালিকানা ফিরে পেতে পারব?

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ