মানুষ-রোবট এক দেহে?-মানব সভ্যতার পরবর্তী অধ্যায়!

মানুষ-রোবট এক দেহে?-মানব সভ্যতার পরবর্তী অধ্যায়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একসময় কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে সীমাবদ্ধ ছিল রোবট। মানুষ কল্পনা করত ধাতব দেহে গড়া বুদ্ধিমান যন্ত্র, যারা হয়তো একদিন মানবজাতিকে শাসন করবে বা পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন পথে হাঁটছে। রোবট এখন মানুষের বিকল্প নয়, বরং সহকর্মী হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন,হিউম্যান–রোবট সিম্বায়োসিস। অর্থাৎ মানুষ ও রোবট একসাথে কাজ করবে, পরস্পরের সীমাবদ্ধতাকে পূরণ করে গড়ে তুলবে এক নতুন ধরণের কর্মজগৎ ও সমাজব্যবস্থা।

প্রকৃতিতে সিম্বায়োসিস হলো এমন এক সম্পর্ক, যেখানে দুই ভিন্ন জীব একে অপরের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে। মৌমাছি ও ফুল, কিংবা মানুষের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রযুক্তির ভাষায় এর অর্থ-মানুষ দেবে সৃজনশীলতা, নৈতিক বিচারবোধ ও আবেগ; রোবট দেবে গতি, নিখুঁততা ও ক্লান্তিহীন শ্রম।
 

কারখানা থেকে সামাজিক জীবনে-

◑ ২০শ শতকের মাঝামাঝি: প্রথম শিল্প রোবট ব্যবহৃত হয় গাড়ি তৈরির কারখানায়। কাজ ছিল শুধু ওয়েল্ডিং বা ভারী যন্ত্রাংশ তোলা।

◑ ১৯৮০–৯০ দশক: রোবট ধীরে ধীরে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। তখনো মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক সীমিত ছিল।

◑ ২১শ শতকের শুরু: এআই, মেশিন লার্নিং ও সেন্সর প্রযুক্তির উন্নতিতে রোবট মানুষের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও কাজ বুঝতে শুরু করে।

◑ বর্তমান: সার্জারি, কৃষি, শিক্ষা এমনকি গৃহস্থালিতেও মানুষ–রোবট একসাথে কাজ করছে।

 

আজকের পৃথিবীতে মানুষ–রোবট সিম্বায়োসিসের বাস্তব প্রয়োগ:

⇨ চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব: আধুনিক সার্জারিতে রোবটিক বাহু চিকিৎসককে সহায়তা করছে অতিসূক্ষ্ম কাটাছেঁড়ায়। জটিল অপারেশনে মানুষের হাত যেখানে কাঁপতে পারে, রোবট সেখানে দেয় নির্ভুল সহায়তা। তবে সিদ্ধান্ত, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও রোগীর প্রতি সহানুভূতি এখনো ডাক্তারই দেয়।
 

⇨ কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: ড্রোন মাটির আর্দ্রতা ও ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করছে, স্বয়ংক্রিয় মেশিন সার ও কীটনাশক ছিটাচ্ছে। কৃষক পরিকল্পনা করছে, রোবট তার সঠিক বাস্তবায়ন করছে। এতে উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে এবং সময় বাঁচছে।
 

⇨ শিল্প কারখানা: ভারী ধাতব অংশ তোলা বা বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা রোবটের পক্ষে সহজ। মানুষ তদারকি করছে, নকশা পরিবর্তন করছে, সমস্যা সমাধান করছে। ফলে দুর্ঘটনা কমছে, দক্ষতা বাড়ছে।
 

⇨ শিক্ষা ও গবেষণা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবট শিক্ষকের সহকারী হয়ে ডেটা বিশ্লেষণ, ল্যাব টেস্ট বা অনলাইন শিক্ষায় সাহায্য করছে। গবেষকরা সৃজনশীল চিন্তায় মনোযোগ দিতে পারছেন।
 

⇨ দৈনন্দিন জীবন: প্রবীণ মানুষ বা প্রতিবন্ধীদের সহায়ক রোবট এখন বাস্তবতা। রান্না, ঘর পরিষ্কার, এমনকি একাকী মানুষের সঙ্গী হিসেবেও রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে।
 

কেন প্রয়োজন এই সিম্বায়োসিস?

⇨ মানুষের সীমাবদ্ধতা: ক্লান্তি, ভুলের সম্ভাবনা, বিপজ্জনক পরিবেশে টিকে না থাকা।

⇨ রোবটের সীমাবদ্ধতা: আবেগহীনতা, নৈতিক বিচার না থাকা, সৃজনশীল চিন্তার অক্ষমতা।
 

দুজন একসাথে হলে একে অপরের দুর্বলতা পূরণ করে। ফলে চিকিৎসায় জীবন বাঁচানো, কৃষিতে খাদ্য সংকট মোকাবিলা কিংবা গবেষণায় দ্রুত আবিষ্কার সম্ভব হচ্ছে।

 

নৈতিকতা ও চ্যালেঞ্জ: তবে এই সহাবস্থান পুরোপুরি নির্ভাবনায় ভরা নয়। সামনে কয়েকটি বড় প্রশ্ন অপেক্ষা করছে-

◑ চাকরি হারানোর আশঙ্কা- রোবট মানুষের শ্রম প্রতিস্থাপন করলে কী হবে?

◑ দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা- যদি রোবট কোনো ভুল করে ক্ষতি ঘটায়, দায় নেবে কে-মানুষ নাকি যন্ত্র?

◑ গোপনীয়তা-  হিউম্যান–রোবট সিম্বায়োসিসে রোবট মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করবে। সেগুলোর নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত?

◑ নৈতিক দ্বিধা- রোবটকে কতটুকু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া উচিত? যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া কি রোবটের হাতে যাবে?
 

গবেষকরা মনে করছেন, আগামী দশকে অফিস, হাসপাতাল, ফার্ম কিংবা ঘরে মানুষ–রোবট দল সাধারণ ব্যাপার হয়ে যাবে। একদিকে যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়বে, তেমনি মানুষও সৃজনশীল ও কৌশলগত কাজের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারবে। আরও বড় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এই সিম্বায়োসিস শুধু অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, সামাজিক ও দার্শনিক পরিবর্তনও ডেকে আনবে। মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে হবে-"মানুষ হওয়ার অর্থ কী, এবং প্রযুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান কীভাবে গড়ে তুলতে হবে।"

মানুষ ও রোবটের সম্পর্ক আর কল্পবিজ্ঞান নয়, এটি আজকের বাস্তবতা এবং আগামীর সভ্যতার অংশ। প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাই এই যাত্রার মূল বার্তা। হিউম্যান–রোবট সিম্বায়োসিস আমাদের এমন এক পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রযুক্তি মানুষের শত্রু নয়, বরং সঙ্গী-একসাথে গড়ে তুলবে নতুন সভ্যতা, নতুন সম্ভাবনা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ