কুকুরের মস্তিষ্কে ভালোবাসার রহস্য-বিজ্ঞান বলছে, মালিকের স্নেহই তাদের কাছে খাবারের চেয়ে বড় পুরস্কার !

কুকুরের মস্তিষ্কে ভালোবাসার রহস্য-বিজ্ঞান বলছে, মালিকের স্নেহই তাদের কাছে খাবারের চেয়ে বড় পুরস্কার !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মানুষ ও কুকুরের সম্পর্ক পৃথিবীর প্রাচীনতম বন্ধনগুলোর একটি। হাজার বছর আগে মানুষ যখন শিকার, পাহারা বা সঙ্গী হিসেবে কুকুরকে বশে আনতে শুরু করে, তখন থেকেই এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে রূপ নেয় গভীর ভালোবাসা ও পারস্পরিক আস্থায়। আজকের আধুনিক সমাজে কুকুর শুধু পোষা প্রাণী নয়, বরং অনেক পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই ভালোবাসার বন্ধন কি কেবল অভ্যাসগত, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?

বিজ্ঞানীরা কুকুরের মস্তিষ্ক নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় যে ফলাফল পেয়েছেন, তা এই বন্ধনকে আরও স্পষ্ট করেছে। fMRI (functional magnetic resonance imaging) নামের প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা কুকুরের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করেছেন। সাধারণত মানুষের মস্তিষ্কে আবেগ ও পুরস্কার নির্ধারণকারী অংশ হলো কডেইট নিউক্লিয়াস (caudate nucleus)। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কুকুরের মস্তিষ্কেও একই অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে যখন তারা তাদের প্রিয় মালিকের গন্ধ শোঁকে বা প্রশংসামূলক শব্দ শোনে। অর্থাৎ, মালিকের কণ্ঠস্বর, স্নেহপূর্ণ আচরণ বা এমনকি গন্ধ—সবই কুকুরের কাছে খাবারের মতোই আনন্দদায়ক, কখনো কখনো তার চেয়েও মূল্যবান।
 

খাবার বনাম ভালোবাসা-বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা:

একটি পরীক্ষায় কুকুরদের সামনে দুটি বিকল্প রাখা হয়েছিল। একদিকে ছিল প্রিয় খাবার, আর অন্যদিকে ছিলেন তাদের মালিক, যিনি ডাকছিলেন ও প্রশংসা করছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, অনেক কুকুর খাবারের বদলে ছুটে গিয়েছে মালিকের দিকে। তাদের জন্য খাবারের স্বাদ ক্ষণিকের আনন্দ, কিন্তু মালিকের উপস্থিতি ও স্নেহ দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা ও সুখের অনুভূতি দেয়।

তবে সব কুকুর একই রকম নয়। কিছু কুকুর খাবারকে অগ্রাধিকার দেয়, বিশেষত যাদের স্বভাব খাদ্যনির্ভর। কিন্তু বেশিরভাগ কুকুরের জন্য মালিকের সঙ্গে কাটানো সময়ই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এটি প্রমাণ করে, কুকুরের আবেগিক জগৎ অনেকটাই মানুষের মতো বহুমাত্রিক।
 

অক্সিটোসিন-ভালোবাসার হরমোন: মানুষ ও কুকুরের এই আবেগিক বন্ধনের আরেকটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো অক্সিটোসিন হরমোন। এই হরমোনকে প্রায়শই বলা হয় 'লাভ হরমোন' বা 'বন্ধনের হরমোন'। যখন একটি কুকুর তার মালিকের চোখের দিকে তাকায়, তখন তাদের উভয়ের শরীরে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়।

বিজ্ঞানীরা এর তুলনা করেছেন মা ও শিশুর সম্পর্কের সঙ্গে। যেমন একটি শিশু মায়ের চোখে তাকালে উভয়ের মধ্যেই অক্সিটোসিন বাড়ে এবং ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়, কুকুর ও মালিকের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। এটি প্রমাণ করে, মানুষ ও কুকুরের সম্পর্ক কেবল ব্যবহারিক নয়, বরং জৈবিকভাবে গড়ে ওঠা এক আন্তঃপ্রজাতিগত সংযোগ।
 

কুকুরের সামাজিক বুদ্ধিমত্তা: শুধু ভালোবাসাই নয়, কুকুর মানুষের আবেগও অনুধাবন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, তারা মানুষের মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর এবং দেহভঙ্গি থেকে আনন্দ, রাগ, দুঃখ কিংবা ভয় চিনতে সক্ষম। তাই প্রায়শই দেখা যায়, মালিক মন খারাপ করলে কুকুর কাছে এসে শান্ত করতে চায় বা দুঃখ ভাগাভাগি করে।

এই ক্ষমতা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। দীর্ঘ বিবর্তনের পথে মানুষ ও কুকুর একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে যে, তারা এখন একে অপরের আবেগ বুঝতে ও সাড়া দিতে সক্ষম।
 

ভুল ধারণার সংশোধন: দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই মনে করতেন, কুকুর মানুষকে অনুসরণ করে কেবল খাবারের জন্য। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, এই ধারণা একেবারেই অসম্পূর্ণ। খাবার তাদের জন্য জরুরি হলেও, মালিকের ভালোবাসা, যত্ন এবং উপস্থিতি তাদের মানসিক জগতের এক অপরিহার্য অংশ। কুকুর শুধু একটি পোষা প্রাণী নয়, বরং মানুষের জীবনের সঙ্গী। তাদের মস্তিষ্কের গবেষণা আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ যেমন সম্পর্ক ও আবেগকে গুরুত্ব দেয়, কুকুরও তেমনি সম্পর্কের মূল্য বোঝে এবং স্নেহকে খাবারের সমান, এমনকি তার চেয়েও বড় পুরস্কার মনে করে।
 

কুকুরের মস্তিষ্কের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রমাণ করে, মানুষ ও কুকুরের সম্পর্ক নিছক সুবিধা বা অভ্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। বরং এটি গভীর মানসিক ও জৈবিক বন্ধনের এক অনন্য উদাহরণ। মালিকের ভালোবাসা, প্রশংসা ও চোখের দৃষ্টি কুকুরের কাছে কেবল আনন্দ নয়, নিরাপত্তা ও পরিতৃপ্তির প্রতীক। অতএব, যখন আমরা আমাদের কুকুরকে আদর করি, তার চোখে চোখ রাখি বা তার প্রশংসা করি—সেটি তার কাছে কেবল একটি মুহূর্ত নয়, বরং জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ