বারবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন?জানুন প্যানিক ডিজঅর্ডারের কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
হঠাৎ করে মনে হলো বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, মাথা ঘুরছে, শ্বাস নিতে পারছেন না মনে হচ্ছে এখনই হয়তো মৃত্যু হবে। কিছু মিনিট পর সেই তীব্র অনুভূতি মিলিয়ে গেলেও ভয়ের আঁচ থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ। অনেকেই এটাকে "হার্ট অ্যাটাক" ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম প্যানিক অ্যাটাক, আর যদি এ ধরনের আতঙ্ক বারবার ফিরে আসে তবে সেটিই হয়ে ওঠে প্যানিক ডিজঅর্ডার (Panic Disorder)।
এই ব্যাধি আসলে কেবল মনের খেলা নয়, বরং শরীর ও মস্তিষ্কের জটিল রাসায়নিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। আশ্চর্যের বিষয় হলো যারা এ রোগে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশই প্রথম দিকে বোঝেন না আসল সমস্যাটা কোথায়। ফলে ভুল চিকিৎসা, ভয়, সামাজিক লজ্জা এবং অজ্ঞতার কারণে রোগটি আরও গভীরে বসে যায়।
প্যানিক ডিজঅর্ডার আসলে কী?
প্যানিক ডিজঅর্ডার হলো এক ধরনের Anxiety Disorder, যেখানে হঠাৎ করে প্রবল ভয়ের ঝড় নেমে আসে শরীর ও মনে। কোনো দৃশ্যমান বিপদ ছাড়াই আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন তিনি হয়তো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
প্রধান উপসর্গসমূহ:
১। হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড়।
২। শ্বাসকষ্ট বা গলায় আটকে যাওয়ার অনুভূতি।
৩। মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা।
৪। ঘাম হওয়া, হাত-পা কাঁপা।
৫। শরীর গরম বা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
৬। বুক চেপে আসা, বুকে ব্যথা।
৭। বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারানোর মতো অনুভূতি।
- এই আক্রমণ সাধারণত ১০–২০ মিনিটের মধ্যে তীব্র হয়, তবে ভয় ও মানসিক চাপ অনেক দীর্ঘ সময় ভোগাতে পারে।
কেন হয় এই ব্যাধি?
বিজ্ঞানীরা কয়েকটি বিষয়কে প্যানিক ডিজঅর্ডারের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন-
☞ মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা: সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, ডোপামিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা মস্তিষ্কের "ভয় কেন্দ্র"কে অতিসক্রিয় করে তোলে।
☞ জেনেটিক প্রভাব: পরিবারে কারও উদ্বেগজনিত সমস্যা থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
☞ মানসিক ট্রমা: শৈশবের নির্যাতন, দুর্ঘটনা বা বড় ধরনের মানসিক আঘাত অনেক সময় জীবনের পরবর্তী সময়ে প্যানিক ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি তৈরি করে।
☞ জীবনযাপন ও পরিবেশ: দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ, অনিদ্রা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, কফি বা নিকোটিনের অপব্যবহার, এমনকি সামাজিক অনিশ্চয়তাও এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ২ থেকে ৩ জন জীবনের কোনো এক সময় প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন। নারীদের মধ্যে এ হার পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা সীমিত হলেও, সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে শহুরে এলাকায় উদ্বেগজনিত রোগের হার ক্রমেই বাড়ছে। দীর্ঘ যানজট, কর্মসংস্থান সমস্যা, শিক্ষা ও পারিবারিক চাপ, এমনকি ডিজিটাল আসক্তি মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করছে।
চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপায়:
প্যানিক ডিজঅর্ডারকে "চিরস্থায়ী ভয়" ভেবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সচেতনতা ও চিকিৎসা থাকলে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
⇨ সাইকোথেরাপি: বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) আক্রান্ত ব্যক্তিকে শেখায় কীভাবে ভয়ের অনুভূতিকে মোকাবিলা করতে হয়।
⇨ ওষুধ: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ দিয়ে থাকেন।
⇨ লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
◑ প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম
◑ নিয়মিত শরীরচর্চা
◑ ধূমপান ও ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা
◑ যোগব্যায়াম, ধ্যান বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের চর্চা
⇨ সহযোগিতা ও সচেতনতা: পরিবার ও সমাজের সমর্থন একজন রোগীর সুস্থতায় বড় ভূমিকা রাখে।
প্যানিক ডিজঅর্ডার কোনো দুর্বলতার নাম নয়, এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি। কিন্তু আমাদের সমাজে মানসিক রোগ মানেই লজ্জা বা অস্বীকার-এ মনোভাবই রোগটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে। মনে রাখা দরকার, যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা যায়, তেমনই সময়মতো চিকিৎসা নিলে প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকেও মুক্তি সম্ভব। একটি আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা যেন পুরো জীবনের মানচিত্রকে বদলে না দেয়-এই সচেতনতা ও সহমর্মিতাই হতে পারে রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।