অতীতের ভয় কি এখনও তাড়া করে? বিস্তারিতভাবে জানুন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের লক্ষণ ও প্রতিকার

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
এক মুহূর্তেই জীবন পাল্টে যেতে পারে। ভয়াবহ দুর্ঘটনা, সহিংসতা, প্রিয়জন হারানো কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অভিজ্ঞতা মানুষকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও বিধ্বস্ত করে তোলে। ক্ষত সেরে উঠলেও মনে জমে থাকা সেই আঘাত সহজে মুছে যায় না। অনেকে আবার দিনের পর দিন ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠেন, হঠাৎ আতঙ্কিত হন, কিংবা মনে হয় সবকিছু আবারও ঘটতে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এই অবস্থাকে বলে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD)। এটি একটি মানসিক অবস্থা, যা অদৃশ্য ক্ষতের মতো ভেতরে ভেতরে একজন মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।
PTSD কীভাবে তৈরি হয়?
PTSD আসলে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া, যা ঘটে যখন একজন মানুষ কোনো ভয়াবহ, জীবন-হুমকির মতো পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন অথবা অন্যকে আক্রান্ত হতে দেখেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘটনার পরপরই এর লক্ষণ দেখা দেয় না; বরং সাধারণত তিন মাস পর থেকে ধীরে ধীরে সমস্যা প্রকট হতে শুরু করে।
কোন কোন অভিজ্ঞতা PTSD-এর জন্ম দেয়?
⇨ পারিবারিক সহিংসতা বা দীর্ঘদিনের নির্যাতন
⇨ প্রিয়জনের মৃত্যু বা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করা
⇨ যুদ্ধ, সন্ত্রাসী হামলা বা সহিংস অপরাধ
⇨ প্রাকৃতিক দুর্যোগ—ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা
⇨ ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতা
⇨ সড়ক দুর্ঘটনা বা শারীরিক আঘাত
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু ভুক্তভোগীই নন, এমনকি কারো ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেও PTSD তৈরি হতে পারে।
আক্রান্ত হলে কী ঘটে?
PTSD-তে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে নানা পরিবর্তন ঘটে, যেমন—
☞ বারবার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি:
◑ মনে হয় ঘটনা আবারও ঘটছে।
◑ ঘনঘন দুঃস্বপ্ন।
◑ ভয়াবহ স্মৃতি হঠাৎ সামনে ভেসে ওঠা।
☞ স্মৃতির বিভ্রাট:
◑ ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করতে না পারা।
◑ সাময়িক স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া।
☞ অতিরিক্ত সতর্কতা ও প্রতিক্রিয়া:
◑ ছোট শব্দে চমকে ওঠা।
◑ অস্বাভাবিক আতঙ্ক ও উদ্বেগ।
◑ হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে ওঠা।
☞ এড়িয়ে চলা:
◑ ঘটনার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় এমন স্থান, মানুষ বা জিনিস থেকে দূরে থাকা।
◑ সামাজিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন ঘটে?
PTSD শুধু মানসিক সমস্যাই নয়, এর গভীর স্নায়বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে—
⇨ অ্যামিগডালা: ভয় নিয়ন্ত্রণকারী অংশ অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ভয়কে বাড়িয়ে দেয়।
⇨ হিপোক্যাম্পাস: স্মৃতি গঠনে দুর্বল হয়ে যায়, ফলে স্মৃতিভ্রংশ দেখা দেয়।
⇨ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স: যুক্তি ও বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা কমে যায়।
এই কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি সামান্য ঘটনাতেও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখান।
চিকিৎসা ও করণীয়: PTSD দীর্ঘমেয়াদি হলেও চিকিৎসা সম্ভব—
⇨ থেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), এক্সপোজার থেরাপি কার্যকর প্রমাণিত।
⇨ ওষুধ: বিশেষ ক্ষেত্রে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ ব্যবহার হয়।
⇨ সমর্থন: পরিবার ও বন্ধুদের বোঝাপড়া এবং মানসিক সহমর্মিতা রোগীর সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
⇨ স্ব-যত্ন: ধ্যান, যোগব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
PTSD কোনো ব্যক্তির দুর্বলতার প্রমাণ নয়, বরং ভয়াবহ অভিজ্ঞতার প্রতি মানবমনের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে চিকিৎসা না নিলে এটি বছরজুড়ে একজন মানুষকে পীড়িত করে রাখতে পারে। সচেতনতা, দ্রুত মানসিক সহায়তা এবং সহমর্মিতা একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে আবারও জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে।
জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়তো মুছে যাবে না, কিন্তু তা মোকাবিলা করা সম্ভব। অদৃশ্য এই আঘাতকে উপেক্ষা না করে বোঝা, গ্রহণ করা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে অন্ধকারের ভেতর থেকেও আলোয় ফেরার পথ তৈরি করা যায়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।