অবসাদ আর অনিদ্রার গোপন ওষুধ? CBT-তেই লুকিয়ে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আধুনিক জীবনে মানসিক চাপ, উদ্বেগ কিংবা অবসাদ যেন অদৃশ্য ছায়ার মতো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাই এখন ওষুধের পাশাপাশি গুরুত্ব পাচ্ছে এক বৈজ্ঞানিক ও কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি—কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা CBT (Cognitive Behavioral Therapy)। এটি একটি কার্যকর মনোসামাজিক হস্তক্ষেপ, যা মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কাজ করে। মূল ধারণা হলো—আমাদের চিন্তাভাবনা সরাসরি আবেগ ও আচরণকে প্রভাবিত করে, আর সেই চিন্তাকে বদলাতে পারলেই জীবনের ধারা পরিবর্তন করা সম্ভব।
CBT আসলে কী?
CBT হলো একটি লক্ষ্য-ভিত্তিক ও ব্যবহারিক থেরাপি, যেখানে ব্যক্তিকে তার অকার্যকর বা নেতিবাচক চিন্তার ধরণগুলো চিহ্নিত করতে শেখানো হয়। এরপর থেরাপিস্ট তাকে বোঝান কীভাবে সেই চিন্তাকে আরও বাস্তবসম্মত, যৌক্তিক ও ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তর করা যায়। এর প্রভাব শুধু মানসিক শান্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আচরণগত পরিবর্তনেও প্রতিফলিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি যদি সামাজিক পরিবেশে ভয়ের কারণে অস্বস্তি বোধ করেন, CBT তাকে শেখায় তার সেই ভয় আসলে কতটা বাস্তবসম্মত। যখন সে বোঝে যে অন্যেরা তাকে সবসময় বিচার করছে না, বরং নিজের আত্মবিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিতে পারে,তখন তার আচরণেও পরিবর্তন আসে।
CBT যেভাবে কাজ করে:
⇨ চিন্তা নিয়ন্ত্রণ: প্রথম ধাপে ব্যক্তি তার নেতিবাচক চিন্তার ধরণগুলো চিহ্নিত করে। যেমন "আমি ব্যর্থ", "আমি কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নই"। এরপর সেগুলোকে যুক্তিনির্ভরভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
⇨ আবেগ নিয়ন্ত্রণ: যখন ভুল বা অযৌক্তিক চিন্তা বদলানো যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আবেগেও পরিবর্তন আসে। উদ্বেগ, ভয় কিংবা দুঃখ কমে যায়।
⇨ ব্যবহারিক দক্ষতা বিকাশ: CBT শুধু চিন্তার পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষকে ব্যবহারিক দক্ষতা শেখায়। যেমন—সমস্যা সমাধান করার কৌশল, চাপের মুহূর্তে শান্ত থাকা, কিংবা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস।
⇨ আচরণগত পরিবর্তন: চিন্তা ও আবেগ যখন ইতিবাচকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন আচরণেও পরিবর্তন আসে। ব্যক্তি ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে উঠে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে এবং নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে সক্ষম হয়।
CBT কী কী সমস্যায় কার্যকর?
বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে CBT নানা ধরণের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সমাধানে কার্যকর:
⇨ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, ফোবিয়া, PTSD, OCD, খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধি, নেশা বা আসক্তি
⇨ জীবনের কঠিন পরিস্থিতি: মানসিক চাপ, শোক, সম্পর্ক ভাঙন বা বিবাহবিচ্ছেদ
⇨ শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা: অনিদ্রা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, মাথাব্যথা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ক্রনিক অসুস্থতার মানসিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর
CBT আসলে মস্তিষ্কের নিউরাল প্যাটার্ন বা স্নায়বিক কার্যক্রমে পরিবর্তন আনে। নেতিবাচক চিন্তা যখন ধীরে ধীরে ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তরিত হয়, তখন ভয় ও চাপ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ (যেমন অ্যামিগডালা) ভারসাম্যে আসে। এর ফলে ব্যক্তি শুধু মানসিকভাবে সুস্থ হয় না, বরং শারীরিক কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
CBT কোনো সাধারণ 'কথোপকথন' নয় এটি একটি বৈজ্ঞানিক কাঠামোবদ্ধ থেরাপি। এজন্য প্রয়োজন একজন প্রশিক্ষিত ও যোগ্য মনোবিজ্ঞানী বা থেরাপিস্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা রোগীকে বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্টের কাছে পাঠান। তবে CBT সফল করতে হলে রোগীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নিয়মিত অনুশীলন অপরিহার্য।
একবিংশ শতাব্দীতে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাকে আর উপেক্ষা করা যায় না। ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা অনিদ্রা ঠিক ততটাই বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ, যতটা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস। CBT এই বার্তাই দেয় যে মানসিক অসুস্থতা দুর্বলতার প্রতীক নয়, বরং সঠিক চিকিৎসা পেলে জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। চিন্তা, আবেগ ও আচরণের এই বৈজ্ঞানিক সংযোগই CBT-কে আজকের পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার অন্যতম নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।