চুই ঝালের গরুর মাংস রেসিপি খুলনার ঘ্রাণময় ঝাঁজে মুগ্ধ হবে মন ও জিভ!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
খুলনার আকাশে যখন নদীর বাতাস মিশে যায় লবণাক্ত গন্ধে, তখন সেই হাওয়ায় ভেসে আসে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ চুইঝাল মাংসের। এই ঘ্রাণ খুলনার মানুষের কাছে শুধু ক্ষুধা জাগানো সুবাস নয়, বরং পরিচয়ের প্রতীক, গর্বের ঐতিহ্য। শত বছর ধরে এই অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামের রান্নাঘরে চুইঝালের ঝাঁঝ মিশে আছে, ঠিক যেমন মাটিতে মিশে আছে তাদের পরিশ্রম ও ভালোবাসা।
চুইঝাল গরুর মাংস শুধু একটি খাবার নয়, এটি একরকম সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যা খুলনার রান্নাকে করেছে স্বতন্ত্র, অনন্য এবং অবিস্মরণীয়। মাংসের প্রতিটি ফোঁটায় চুইঝালের তীব্র ঝাঁঝ এমনভাবে মিশে থাকে, যেন সেই ঝাল শুধু জিহ্বায় নয় বরং নাক, চোখ, এমনকি স্মৃতিতেও ছাপ রেখে যায়।
চুইঝাল এক রহস্যময় ঝাঁঝের উৎস!
চুইঝাল (বৈজ্ঞানিক নাম Piper chaba) একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ, যা মূলত গোলমরিচ গোত্রের সদস্য। খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলের নদীবিধৌত মাটিতে এটি জন্মায় প্রাকৃতিকভাবে। গাছের কান্ড ও মূল অংশই রান্নায় ব্যবহৃত হয়, যা ধীরে ধীরে সিদ্ধ হলে নিঃসৃত হয় এক বিশেষ প্রাকৃতিক তেল। এই তেলেই লুকিয়ে আছে চুইঝালের আসল শক্তি যা খাবারে দেয় ঝাঁঝ, সুগন্ধ এবং গভীর এক স্বাদ। খুলনার মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটি ব্যবহার করে আসছে হজমের উপকারীতা ও শরীর উষ্ণ রাখার গুণে।
চুইঝালের ঝাঁঝ বা "উষ্ণতা" আসলে এর ভিতরে থাকা পাইপেরিন ও চাবাইন নামক যৌগের কারণে। এই যৌগগুলো মুখে একধরনের রিসেপ্টর উদ্দীপিত করে, যা মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ ঘটায়। এর ফলে চুইঝালের ঝাঁঝে যেমন আগুন লাগে, তেমনি মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রশান্তি আসে যা মানুষকে বলে তোলে "আরেকটু দাও!" বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, চুইঝাল শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং হজমে সহায়ক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং প্রদাহনাশক হিসেবেও কাজ করে। ভারী খাবার যেমন গরুর মাংসের সঙ্গে এর যুগলবন্দি তাই একেবারে নিখুঁত।
খুলনার ঘরে ঘরে চুইঝাল মাংস রান্না হয় ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে যেন প্রতিটি ধাপে জমে ওঠে ভালোবাসা ও ধৈর্যের স্বাদ।
উপকরণ:
গরুর মাংস, চুইঝাল (ছোট টুকরো করা), পেঁয়াজ কুচি, আদা বাটা, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, জিরা গুঁড়া, ধনে গুঁড়া, গরম মসলার গুঁড়া, লবণ, তেল, টকদই, আলু (ঐচ্ছিক), লেবুর রস ও জিরা ভাজা গুঁড়া।
প্রণালী:
⇨ মাংস ধুয়ে লবণ ও টকদই দিয়ে ভালোভাবে মেখে এক ঘণ্টা মেরিনেট করুন। এতে মাংস নরম ও সুগন্ধযুক্ত হবে।
⇨ তেল গরম করে পেঁয়াজ সোনালি করুন, তারপর আদা-রসুন বাটা, হলুদ, মরিচ, ধনে, জিরা গুঁড়া দিয়ে ধীরে ধীরে কষান।
⇨ মেরিনেট করা মাংস ও ছোট কাটা চুইঝাল (ইচ্ছা হলে আলু) দিয়ে কয়েকবার ভালোভাবে কষান, যতক্ষণ না মসলার তেল আলাদা হয়।
⇨ পানি দিয়ে ঢেকে দিন, মাংস নরম হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ঝোল ঘন হয়ে এলে বুঝবেন চুইঝালের স্বাদ মাংসের গভীরে পৌঁছে গেছে।
⇨ গরম মসলার গুঁড়া, জিরা ভাজা গুঁড়া ও লেবুর রস ছড়িয়ে দিন। এই টক ও ঝাঁঝের মিশ্রণই খুলনার রান্নার স্বাক্ষর।
তারপর পালা পরিবেশনের। গরম ভাত বা রুটির সঙ্গে পরিবেশন করুন—এক চামচ খেলেই বুঝবেন, কেন এই খাবার খুলনার ঐতিহ্যের হৃদয়স্পন্দন।
খুলনার চুইঝাল মাংস এখন শুধু গ্রামের রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আজ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে, এমনকি প্রবাসী বাঙালিদের ডাইনিং টেবিলেও জায়গা করে নিয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলেন,"আসল চুইঝালের ঝাঁঝ বুঝতে হলে খুলনার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হয়।"
এই খাবার খুলনার মানুষের জন্য গর্বের, কারণ এতে মিশে আছে তাঁদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, মাটির সঙ্গে সম্পর্ক, আর প্রজন্মের জ্ঞান। প্রতিটি কামড়ে সেই মাটির ঘ্রাণ, নদীর হাওয়া আর পুরোনো দিনের গল্প যেন ফিরে আসে জিহ্বার ডগায়।
চুইঝাল গরুর মাংস কেবল একটি রেসিপিই নয় এটি খুলনার এক আবেগময় ইতিহাস। এর প্রতিটি উপাদান, প্রতিটি ঘ্রাণ বলে দেয় স্থানীয় মানুষের খাদ্যবোধ, প্রকৃতি নির্ভর জীবনধারা ও ঐতিহ্যের টিকে থাকা লড়াইর কথা।
আজকের দ্রুতবেগের দুনিয়ায় এই খাবার মনে করিয়ে দেয় ধৈর্যের সৌন্দর্য,যেভাবে ধীরে ধীরে কষানো চুইঝাল মাংসের প্রতিটি ফোঁটায় জমে থাকে সময়, ভালোবাসা আর স্মৃতি।
চুইঝালের ঝাঁঝ শুধু মুখে নয় এটি খুলনার আত্মায় মিশে থাকা এক অনন্ত স্বাদ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রসনাতৃষ্ণার গল্প বলে যায়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।