মঙ্গলে ভেসে গেল পৃথিবীর আওয়াজ!স্পেস সাউন্ড ট্রান্সমিশনে শুরু এক নতুন যুগ

মঙ্গলে ভেসে গেল পৃথিবীর আওয়াজ!স্পেস সাউন্ড ট্রান্সমিশনে শুরু এক নতুন যুগ
ছবির ক্যাপশান, মঙ্গলে ভেসে গেল পৃথিবীর আওয়াজ!স্পেস সাউন্ড ট্রান্সমিশনে শুরু এক নতুন যুগ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মঙ্গল গ্রহে "শব্দ পাঠানো" শুনতে যেন সাই-ফাই সিনেমার গল্প। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের জ্ঞানের দীর্ঘ এক বিবর্তন। বাস্তবে এখনো কেউ মঙ্গলে সরাসরি "মানব কণ্ঠ" বা "অডিও" পাঠায়নি, কারণ শব্দ তরঙ্গ (Sound Wave) স্পেসে চলাচল করতে পারে না। তবুও, মানুষ মঙ্গলে পাঠিয়েছে রেডিও সংকেত, ডেটা, এবং বৈজ্ঞানিক 'সাউন্ড ডেটা' যা যোগাযোগ প্রযুক্তির এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। এই অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং পরবর্তীতে ভারত নিজেদের প্রযুক্তি দিয়ে দেখিয়েছে, কিভাবে মঙ্গলের দূরত্ব আর শুধু কল্পনা নয় বাস্তবের এক বৈজ্ঞানিক গন্তব্য।

১৯৫৭,সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহসী সূচনা:

মঙ্গলে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের Mars প্রোগ্রাম দিয়ে।

তাদের প্রথম অভিযানগুলো ব্যর্থ হলেও, প্রযুক্তির সীমা ছাপিয়ে তারা ১৯৭১ সালে পাঠায় Mars 3 মিশন, যা মানব ইতিহাসে প্রথম soft landing সম্পন্ন করে। Mars 3 ল্যান্ডার মঙ্গলের পৃষ্ঠে পৌঁছে মাত্র ২০ সেকেন্ডের জন্য সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম হয়। সিগন্যালটি ছিল ইলেকট্রনিক ডেটা, যাতে বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা ও পৃষ্ঠের চাপ সংক্রান্ত তথ্য ছিল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবুও এটি ছিল "মঙ্গলের প্রথম সাউন্ড-ডেটা ট্রান্সমিশন" বা প্রথম শব্দ-তথ্যের ইঙ্গিত। এই ক্ষণস্থায়ী বার্তাই পরবর্তীতে অনুপ্রেরণা দেয় পৃথিবীর সব মহাকাশ সংস্থাকে -"সেখানে কিছু শোনা গিয়েছিল" এই বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় মঙ্গলের সাউন্ড রিসার্চ যুগ।

১৯৬৪, নাসার মেরিনার ৪ প্রথম বাস্তব সংযোগ:

১৮ নভেম্বর, ১৯৬৪ সালে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA) উৎক্ষেপণ করে Mariner 4 যা মঙ্গলের প্রথম সফল ফ্লাইবাই মিশন।

এটি ১৯৬৫ সালের ১৫ জুলাই মঙ্গল গ্রহের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে এবং পাঠায় ইতিহাসের প্রথম ২১টি ছবি ও ডেটা। এই ডেটাগুলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল প্রায় ৮ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। প্রতিটি সিগন্যাল ছিল ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যা পরে রূপান্তরিত হয় ফটোগ্রাফে, বা সহজভাবে বললে "ডিজিটাল শব্দের ছবি"।

এটি প্রথম প্রমাণ দেয় যে, মানুষ রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে কোটি কিলোমিটার দূর থেকেও যোগাযোগ করতে পারে। Mariner 4-ই প্রথম প্রমাণ করে—"Space Sound" মানে হলো তথ্যের সংকেত, কণ্ঠ নয়।

১৯৭৬, ভাইকিং মিশন মঙ্গলের বায়ুর "সাউন্ড":

এরপর আসে NASA Viking 1 ও Viking 2, ১৯৭৬ সালে।

এই দুটি ল্যান্ডার শুধু মঙ্গল পৃষ্ঠের ছবি ও মাটির নমুনাই নেয়নি, বরং বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব, চাপ ও কম্পনের ডেটা রেকর্ড করে। এই সেন্সরগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের বায়ুর গতিবেগ ও হালকা চাপ-তরঙ্গের 'সাউন্ড সিগনেচার' শনাক্ত করেন।

এটি ছিল প্রথমবারের মতো "মঙ্গলের বাতাসের শব্দ" যা শোনা যায়নি, কিন্তু অনুভূত হয়েছিল যন্ত্রের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা তখনই ঘোষণা করেন—"Sound doesn't travel in space, but data does." অর্থাৎ, শব্দ নয়, তথ্যই মহাকাশের ভাষা।

২০১৪, ভারতের মঙ্গলযান কম বাজেটে বড় সাফল্য:

২০১৪ সালে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ISRO উৎক্ষেপণ করে Mars Orbiter Mission (MOM), যা পরিচিত 'মঙ্গলযান' নামে। এটি ভারতের প্রথম আন্তঃগ্রহ মিশন, এবং প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হয়, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। মঙ্গলযান মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, পৃথিবী থেকে প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিমি দূরে। এটি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল, ধূলিকণা, ও পৃষ্ঠের রাসায়নিক গঠন নিয়ে তথ্য পাঠায়।

যদিও এটি কোনো "অডিও সিগন্যাল" পাঠায়নি, কিন্তু এর মাধ্যমে পৃথিবী প্রথম জানতে পারে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে 'ইনফ্রাসনিক সাউন্ড' বা অতি নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গের উপস্থিতি।

এই তরঙ্গের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা বোঝেন মঙ্গলে ঝড় বা ধূলিঝড় কেমন 'শব্দ' সৃষ্টি করে, যা মানুষের কানে শোনা না গেলেও সেন্সরে ধরা পড়ে।

মঙ্গলে শব্দের অস্তিত্ব:

মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ পাতলা। তাই সেখানে শব্দ তরঙ্গ ধীরগতিতে চলে যা প্রায় ২৪০ মিটার/সেকেন্ড, যেখানে পৃথিবীতে তা ৩৪০ মিটার/সেকেন্ড।

২০২১ সালে নাসার Perseverance Rover প্রথমবার মঙ্গলে আসল শব্দ রেকর্ড করে রোভার-এর নিজের লেজার স্ক্যান, বায়ুর গতি ও পাথরের প্রতিধ্বনি। এটাই ছিল মানুষের তৈরি যন্ত্রে ধরা মঙ্গলের প্রকৃত "সাউন্ড ওয়েভ" যা ৬০ বছরের গবেষণার ফল।

যেভাবে 'ডেটা' পৃথিবীতে ফিরে আসে-

মঙ্গলের প্রতিটি মিশন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখে Deep Space Network (DSN) নামের এক বিশাল রেডিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

এই অ্যান্টেনাগুলো যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত, যাতে মঙ্গলের সাথে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ বজায় থাকে। মঙ্গলের ডেটা পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় নেয় ৫ থেকে ২০ মিনিট, গ্রহের দূরত্ব অনুযায়ী। এই ডেটার ভেতর থাকে ছবি, চাপ, তাপমাত্রা, এমনকি মাইক্রোফোনে রেকর্ড হওয়া শব্দ-তরঙ্গ। অর্থাৎ, আজ মানুষ সরাসরি মঙ্গলের বাতাস "শুনতে" পারে। তবে সেটি প্রযুক্তির কানে, মানব কানে নয়।

মঙ্গলে "প্রথম শব্দ" এখনো পাঠানো হয়নি, কিন্তু "প্রথম বার্তা" পাঠানো হয়েছিল বহু আগেই

১৯৬৪ সালে Mariner 4 এর মাধ্যমে। তারপর সোভিয়েত Mars 3, Viking, এবং ভারতের মঙ্গলযান প্রতিটি মিশন প্রমাণ করেছে, মানুষ শুধু পৃথিবীর প্রাণ নয়, মহাকাশেরও এক শ্রোতা ও বক্তা। আজ নাসার রোভার যখন মঙ্গলের বাতাসের ফিসফিসানি ধরে, তখন মনে হয়

"শব্দটা শুধু তরঙ্গে নয়, জ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, এবং মানব কৌতূহলের স্পন্দনে বেঁচে আছে।"

মঙ্গলে শব্দ এখনো পৌঁছেনি মানব কণ্ঠে, কিন্তু মানবতার 'কণ্ঠস্বর' সেখানে বহু আগেই প্রতিধ্বনি তুলেছে ডেটার ভাষায়, প্রযুক্তির স্পন্দনে, বিজ্ঞানের ছোঁয়ায়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ