বিদ্যুৎ বিপ্লবে নতুন দিগন্ত! যা এক রাতে বদলে দিতে পারে আমাদের বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো বিদ্যুৎ। কিন্তু আজও পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় নষ্ট হয় তাপ আকারে। তারের প্রতিরোধ, শক্তি অপচয় এবং ব্যয়সাপেক্ষ অবকাঠামো সব মিলিয়ে এই ক্ষতি রোধ করা প্রায় অসম্ভব বলে ধরা হতো। কিন্তু বিজ্ঞানের এক অনন্য ধারণা 'সুপারকন্ডাক্টিভিটি'-এই অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সুপারকন্ডাক্টিভিটি কী?
সহজভাবে বললে, কোনো পদার্থ যখন এক নির্দিষ্ট নিম্ন তাপমাত্রায় গিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহণের সময় শূন্য প্রতিরোধে (zero resistance) কাজ করে, তখন তাকে বলা হয় সুপারকন্ডাক্টর। অর্থাৎ, এর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চলবে কোনো শক্তি অপচয় ছাড়াই।
এই বৈশিষ্ট্য প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯১১ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেইকে কামারলিঙ অনেসের হাতে, যিনি পারদের তাপমাত্রা প্রায় -২৬৯°C এ নামিয়ে আনলে দেখেন বিদ্যুৎ প্রতিরোধ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় এই রহস্যময় ঘটনাকে বোঝার এক শতাব্দীরও বেশি দীর্ঘ যাত্রা।
কীভাবে কাজ করে এই বিস্ময়?
সাধারণভাবে, ধাতুর ভেতরে ইলেকট্রন চলাচল করলে তা ল্যাটিস কাঠামোর পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষে তাপ উৎপন্ন করে, যার ফলেই বিদ্যুৎ প্রতিরোধ ঘটে। কিন্তু সুপারকন্ডাক্টর অবস্থায়, ইলেকট্রনরা জোড়া বেঁধে 'কুপার পেয়ার (Cooper Pair)' তৈরি করে এবং সংঘর্ষ ছাড়াই একত্রে প্রবাহিত হয়।
ফলাফল??
কোনো তাপ উৎপন্ন হয় না, বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয় না, শক্তি ক্ষয় শূন্যে নেমে আসে। এ যেন বিদ্যুতের জন্য একটি ঘর্ষণহীন মহাসড়ক।
দীর্ঘদিন ধরে সুপারকন্ডাক্টিভিটি শুধু অতি নিম্ন তাপমাত্রায় দেখা যেত, যা তরল হিলিয়াম বা নাইট্রোজেনের সাহায্যে বজায় রাখতে হতো। এতে খরচ ও জটিলতা বেড়ে যেত বহুগুণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন উচ্চ-তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর (High-Temperature Superconductors), যা তুলনামূলকভাবে সহজ পরিবেশে কাজ করতে সক্ষম। এসব নতুন উপাদান, যেমন কপার অক্সাইড বা হাইড্রোজেন যৌগ, হয়তো ভবিষ্যতে কক্ষতাপমাত্রাতেও (Room Temperature) সুপারকন্ডাক্টিভিটি আনতে পারবে যা হবে মানব ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক অর্জন।
প্রযুক্তি ও ব্যবহার:
সুপারকন্ডাক্টরের ব্যবহার কেবল গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ধীরে ধীরে বাস্তব দুনিয়ায় প্রবেশ করছে
⇨ বিদ্যুৎ পরিবহণে: যদি পাওয়ার গ্রিডে সুপারকন্ডাক্টর তার ব্যবহার হয়, তবে শক্তি অপচয় প্রায় শূন্যে নামবে।
⇨ ম্যাগলেভ ট্রেন: জাপান ও চীনে ব্যবহৃত চৌম্বক ভাসমান ট্রেন (Maglev Train) সুপারকন্ডাক্টিভ চৌম্বক বলের সাহায্যে ঘর্ষণহীনভাবে ছুটে চলে।
⇨ চিকিৎসা প্রযুক্তিতে: MRI স্ক্যানারগুলোর চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে সুপারকন্ডাক্টর কয়েল।
⇨ কোয়ান্টাম কম্পিউটার: ভবিষ্যতের অতিগতি সম্পন্ন কম্পিউটার তৈরির মূল উপাদান হিসেবেও সুপারকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে পথটা এখনও সহজ নয়। উচ্চ চাপ, জটিল উপাদান, অতিশীতলতা এবং স্থিতিশীলতা সব মিলিয়ে সুপারকন্ডাক্টরকে দৈনন্দিন ব্যবহারের পর্যায়ে আনতে এখনও অনেক গবেষণা দরকার। অনেক সময় নতুন উপাদান ল্যাবরেটরিতে সফল হলেও বাস্তব পরিবেশে তা অস্থির হয়ে পড়ে।
সুপারকন্ডাক্টিভিটি কেবল বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন নয়, বরং ভবিষ্যতের জ্বালানি বিপ্লবের সম্ভাবনাময় দিগন্ত। পৃথিবীতে বিদ্যুৎ অপচয় যদি একদিন শূন্যে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে পরিবেশ দূষণ কমবে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে, আর মানব সভ্যতা প্রবেশ করবে এক নতুন জ্ঞান-ভিত্তিক শক্তির যুগে। একটি প্রতিরোধহীন তার হয়তো একদিন বদলে দেবে সমগ্র বিশ্বের বিদ্যুৎ প্রবাহ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।