স্পর্শেই পাতা ভাঁজ! লজ্জাবতী ফুলের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়ার কারণ জানেন কি?

স্পর্শেই পাতা ভাঁজ! লজ্জাবতী ফুলের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়ার কারণ জানেন কি?
ছবির ক্যাপশান, স্পর্শেই পাতা ভাঁজ! লজ্জাবতী ফুলের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়ার কারণ জানেন কি?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

স্পর্শ করতেই মুহূর্তে পাতা মুড়ে নেয় নিজেকে এই আচরণে লজ্জাবতী (Mimosa pudica) ফুল যেন প্রকৃতির সবচেয়ে লাজুক প্রাণ! গ্রামের পথে কিংবা শহরের বাগানে, এই উদ্ভিদ স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে পাতাগুলো ভাঁজ করে ফেলে যেন 'লজ্জা' পেয়েছে। কিন্তু আসলে এটি কোনো আবেগ নয়, বরং এক বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়া, যা উদ্ভিদের স্নায়ুব্যবস্থার অনুরূপ এক প্রক্রিয়ার ফল।

লজ্জাবতী গাছের পাতা মোচড়ানো প্রতিক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন "seismonastic movement" অর্থাৎ স্পর্শ, কম্পন, তাপমাত্রা বা আলো পরিবর্তনের মতো যান্ত্রিক উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া। পাতার গোড়ায় থাকে এক বিশেষ টিস্যু, যাকে বলে pulvinus (পালভিনাস)। এটি একধরনের স্পঞ্জের মতো কোষসমষ্টি, যা পানিতে ফুলে থাকে। যখন কেউ পাতায় হাত দেয় বা হালকা ধাক্কা লাগে তখন-

➤ কোষের ভেতরের আয়ন (বিশেষ করে পটাশিয়াম আয়ন) দ্রুত এক দিক থেকে অন্য দিকে সরে যায়,

➤ ফলে পানির চাপ (turgor pressure) হঠাৎ কমে যায়,

➤ আর সেই চাপ কমে গেলে কোষগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যায়,

➤ ফলেই পাতাগুলো হঠাৎ ভাঁজ হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এই প্রক্রিয়া কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে এবং কিছুক্ষণ পর আবার পানি ফিরে এলে পাতা আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

বিজ্ঞান বলছে এ এক বৈদ্যুতিক সংকেতের বিস্ময়! যদিও উদ্ভিদের মস্তিষ্ক বা স্নায়ু নেই, তবুও লজ্জাবতী ফুলের প্রতিক্রিয়া অনেকটা স্নায়ু সংকেতের মতো বৈদ্যুতিক ইম্পালস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গবেষণায় দেখা গেছে, স্পর্শের সময় পালভিনাস টিস্যুতে Action Potential তৈরি হয় যা প্রাণীদের স্নায়ু কোষে বিদ্যুত্ সংকেত ছড়ানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয়। এই বিদ্যুত্ সংকেতের গতি প্রায় ২০–৩০ মিলিমিটার প্রতি সেকেন্ড, যা উদ্ভিদ জগতে আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত।

অর্থাৎ, লজ্জাবতী ফুল এক অর্থে "সংকেত পাঠানো" ও "প্রতিক্রিয়া দেওয়া" দুটিই করতে পারে, যেন প্রকৃতির নিজস্ব বৈজ্ঞানিক যোগাযোগব্যবস্থা।

এই প্রতিক্রিয়া কেবল সৌন্দর্যের বিষয় নয়, বরং রক্ষার কৌশল (defense mechanism)।

পাতা ভাঁজ হয়ে গেলে উদ্ভিদটি হঠাৎ ছোট ও কম আকর্ষণীয় দেখায়, ফলে পোকামাকড় বা তৃণভোজী প্রাণী এটি খাওয়ার আগ্রহ হারায়।

কেউ ছোঁয়ার সময় হঠাৎ নড়াচড়া করায় শিকারী প্রাণীরা ভয় পায়। তারা ভাবে এটি হয়তো বিপজ্জনক বা বিষাক্ত। এছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টি বা বাতাস থেকেও এই ভাঁজ পাতা জলীয় ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, এটি উদ্ভিদের এক বুদ্ধিদীপ্ত আত্মরক্ষামূলক বিবর্তন, যা "plant intelligence"-এর এক সূক্ষ্ম প্রমাণ।

আধুনিক গবেষণায় লজ্জাবতীর গুরুত্ব-

আজকের উদ্ভিদবিজ্ঞান ও বায়োইলেকট্রনিক্স গবেষণায় লজ্জাবতী ফুল বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

MIT ও টোকিও ইউনিভার্সিটি-এর বিজ্ঞানীরা Mimosa pudica-কে মডেল হিসেবে ব্যবহার করছেন "বায়ো-ইনস্পায়ার্ড সেন্সর" তৈরিতে, যেখানে উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়াশীল টিস্যু থেকে নতুন ধরনের স্পর্শসংবেদনশীল রোবট তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, তাপমাত্রা পরিবর্তন বা মাটির আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণেও এর নড়াচড়া একটি প্রাকৃতিক বায়োসেন্সর হিসেবে কাজ করতে পারে।

যদিও আমরা উদ্ভিদকে নড়াচড়া-বিহীন প্রাণী ভাবি, লজ্জাবতী প্রমাণ করে প্রকৃতিও নিজের মতো করে "চিন্তা ও প্রতিক্রিয়া" করে। স্পর্শ, আলো, শব্দ বা কম্পনে তারা যে ধরনের জৈব সংকেত পাঠায়, তা দেখায় জীবন শুধু প্রাণীর শরীরে নয়, গাছের ভেতরেও প্রবাহিত।

লজ্জাবতী ফুলের "লজ্জা" আসলে এক জটিল পদার্থবৈজ্ঞানিক ও জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যেখানে বিদ্যুত্ সংকেত, জলচাপ ও কোষের প্রতিক্রিয়া একসঙ্গে কাজ করে। প্রকৃতির এই ছোট্ট গাছ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন মানেই প্রতিক্রিয়া চোখে না দেখা অনুভবেও এক রহস্যময় বিজ্ঞান লুকিয়ে থাকে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ