সমুদ্রপৃষ্ঠ উঠছে নিরবেই সবচেয়ে বিপদে বাংলাদেশ, বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা কাঁপাচ্ছে বিশ্ব!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্ব উষ্ণায়নের অগ্নিশ্বাসে আজ কাঁপছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। যে ভূমি একসময় চিরস্থায়ী বরফের চাদরে ঢাকা ছিল, সেই সাদা সাম্রাজ্য আজ ক্রমে হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। গলে যাওয়া বরফের প্রতিটি ফোঁটায় বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, আর তারই সঙ্গে বাড়ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল উপকূলীয় অঞ্চলের উদ্বেগ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার শঙ্কা। গলে যাচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার বরফের সাম্রাজ্য। সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলার হার ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক দ্রুত। বিশেষত পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ তুঙ্গে। কারণ এই অংশের বিশাল বরফস্তরের একটি বড় অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থান করছে। ফলে উষ্ণ সমুদ্রজল সেখানে সরাসরি প্রবেশ করে বরফের নিচের দিক থেকে গলিয়ে দিচ্ছে।
এভাবে বরফ গলে গিয়ে যখন সাগরে মিশে যায়, তখন তা শুধু অ্যান্টার্কটিকার ভূগোলকেই বদলে দিচ্ছে না, বরং সাগরের পানির পরিমাণও বাড়িয়ে তুলছে যা সরাসরি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকা প্রতিবছর প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে। এবং যদি পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বৃহৎ বরফস্তর পুরোপুরি গলে যায়, তবে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠ কয়েক মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে-যা হবে পৃথিবীর জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়।
কেন গলছে এত দ্রুত?
মূল অপরাধী গ্লোবাল ওয়ার্মিং। মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের নির্গমন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। দক্ষিণ মেরুর আশপাশের সাগরজলও উষ্ণ হচ্ছে, যা বরফের তলদেশে গলনের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এছাড়া দক্ষিণ গোলার্ধে বাতাসের গতিপথ পরিবর্তন এবং সাগরের লবণাক্ততার তারতম্য বরফের স্থিতি নষ্ট করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যান্টার্কটিকার "আইস শেলফ"। অর্থাৎ ভাসমান বরফস্তর যখন পাতলা হয়ে যায়, তখন ভেতরের স্থলভাগের বরফও স্থিতি হারিয়ে সাগরে গড়িয়ে পড়ে। এটি এক "চেইন রিঅ্যাকশন"-এর মতো প্রক্রিয়া, যা একবার শুরু হলে থামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
এই বরফ গলার সরাসরি প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর উপকূলীয় দেশগুলোতে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও ভোলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
কেবল ডুবে যাওয়া নয়, বরফ গলার ফলে সমুদ্রের পানি উপকূলে প্রবেশ করে লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে, যা কৃষি জমি ও মিঠা পানির উৎসের জন্য ভয়াবহ হুমকি। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও এ প্রক্রিয়ায় বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
অ্যান্টার্কটিকার বরফ শুধু জমাট পানি নয় এটি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক ঢাল। বরফের উজ্জ্বল সাদা পৃষ্ঠ সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে দেয় (albedo effect), ফলে পৃথিবী ঠান্ডা থাকে। কিন্তু বরফের স্তর কমে গেলে সূর্যের তাপ আরও বেশি শোষিত হয়, পৃথিবী আরও উষ্ণ হয়, এবং উষ্ণতা বাড়লে আরও বরফ গলে এইভাবে শুরু হয় এক অপ্রতিরোধ্য চক্রবৃদ্ধি উষ্ণায়ন।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আরও ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা অ্যান্টার্কটিকার গলন প্রক্রিয়াকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা দল অ্যান্টার্কটিকার বরফস্তরের নিচে সেন্সর বসিয়ে তাপমাত্রা ও ঘনত্বের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বরফের গতি ও আয়তন। এই ডেটা থেকেই তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সূক্ষ্ম বরফ মানচিত্র, যা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস নির্ধারণে সহায়ক হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানাচ্ছেন এটি কোনো স্বল্পমেয়াদি সমস্যা নয়। এমনকি পৃথিবী যদি আজ থেকেই তাপ নির্গমন বন্ধ করে দেয়, তবুও বরফ গলার চলমান প্রক্রিয়া থামানো যাবে না; শুধু তার গতি কিছুটা কমানো যেতে পারে।
ভবিষ্যতের শঙ্কা ও করণীয়:
অ্যান্টার্কটিকার গলন মানে কেবল এক মহাদেশের সংকট নয়, এটি পুরো পৃথিবীর জন্য এক নিঃশব্দ বিপর্যয়ের সূচনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী শতকে যদি বরফ গলার হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে লাখো মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
তাই এখনই প্রয়োজন কার্বন নির্গমন হ্রাস, নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর, এবং উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ।
অ্যান্টার্কটিকার প্রতিটি গলিত বরফকণা পৃথিবীর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ দিচ্ছে। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক পরিবর্তন নয়, বরং মানবসভ্যতার অস্তিত্বের প্রশ্ন। পৃথিবী হয়তো বেঁচে থাকবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি সেই পৃথিবীতে টিকে থাকার মতো পরিবেশ রেখে যেতে পারব!
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।