অদ্ভুত কিন্তু সত্যি! এক কামড়েই টক খাবার হয়ে যায় মিষ্টি, জানুন 'মিরাকল ফ্রুট'এর বৈজ্ঞানিক রহস্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ফলের জগতে এর নামই যেন রহস্যে মোড়া মিরাকল ফ্রুট (Miracle Fruit)। আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলের উষ্ণ বনে জন্ম নেওয়া এই ক্ষুদ্র লাল ফলটি চেহারায় সাধারণ, কিন্তু গুণে অনন্য। কারণ এটি মুখে দিলে টক খাবারও মুহূর্তেই মিষ্টি লাগে! বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া আসলে এক ধরনের প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রভাব, যা মানুষের জিহ্বার স্বাদগ্রহণ প্রক্রিয়াকে সাময়িকভাবে বদলে দেয়।
কোথা থেকে এলো এই "মিরাকল"?
মিরাকল ফ্রুটের বৈজ্ঞানিক নাম Synsepalum dulcificum। এটি মূলত পশ্চিম আফ্রিকার গিনি ও ঘানার জঙ্গলে পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষ শতাব্দী ধরে এই ফল ব্যবহার করে আসছেন বিশেষ করে টক ফল বা পাম ওয়াইন খাওয়ার আগে, যাতে স্বাদ মিষ্টি লাগে।
ফলটি দেখতে ছোট টক-মিষ্টি বেরির মতো, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২–৩ সেন্টিমিটার। তবে এর প্রকৃত জাদু লুকিয়ে আছে এর "মিরাকুলিন (Miraculin)" নামের এক বিশেষ গ্লাইকোপ্রোটিনে।
যেভাবে কাজ করে এই আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া-
মানুষের জিহ্বায় স্বাদ শনাক্ত করার জন্য প্রায় ১০,০০০ টেস্ট বাড থাকে, যেগুলো নির্দিষ্ট প্রোটিন রিসেপ্টরের মাধ্যমে মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিতো বা উমামি স্বাদ অনুভব করে। মিরাকল ফ্রুটের মিরাকুলিন প্রোটিন জিহ্বার মিষ্টি স্বাদগ্রাহী রিসেপ্টরের (sweet receptors) সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেগুলোর প্রতিক্রিয়াকে সাময়িকভাবে পরিবর্তন করে দেয়।
যখন ফলটি খাওয়ার পর কেউ টক কিছু খায় যেমন- লেবু বা ভিনেগার, তখন টকের এসিড মিরাকুলিনের আকৃতি পরিবর্তন করে, ফলে রিসেপ্টর সেটি মিষ্টি হিসেবে অনুধাবন করে। এই প্রভাব সাধারণত ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়, তারপর জিহ্বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
মিরাকল ফ্রুট খাওয়ার পর কেউ যদি লেবুর টুকরো মুখে দেয়, সেটি যেন কমলার মতো মিষ্টি লাগে। ভিনেগার মনে হয় যেন চিনির সিরাপ, এমনকি দই বা দইভিত্তিক খাবারও মিষ্টি স্বাদ পায়।
তাই পশ্চিমা দেশে "flavor-tripping parties" নামে ছোটখাটো সামাজিক আয়োজন হয়, যেখানে মানুষ মিরাকল ফ্রুট খেয়ে বিভিন্ন টক খাবারের "বদলে যাওয়া স্বাদ" উপভোগ করে।
পুষ্টিগুণ ও সম্ভাব্য ব্যবহার:
মিরাকল ফ্রুটে ক্যালোরি খুব কম, কিন্তু এতে ভিটামিন C, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রাকৃতিক ফাইবার রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এটি প্রাকৃতিক সুগার বিকল্প হিসেবে গবেষণায় গুরুত্ব পাচ্ছে।
☞ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সম্ভাবনা: মিরাকুলিনে কোনো চিনি নেই, কিন্তু এটি মিষ্টি অনুভব করায়, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি প্রাকৃতিক স্বাদবর্ধক হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।
☞ কেমোথেরাপি রোগীদের জন্য সহায়ক:
ক্যান্সার চিকিৎসায় অনেক রোগীর জিহ্বার স্বাদগ্রহণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, খাবার টক বা তিতা লাগে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মিরাকল ফ্রুট তাদের জন্য স্বাদের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
☞ ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার:
চিনিমুক্ত পণ্য বা ডায়েট ফুডে প্রাকৃতিক স্বাদবর্ধক হিসেবে এর প্রয়োগ বাড়ছে। তবে এখনো বাণিজ্যিকভাবে এটি সীমিত পরিসরে পাওয়া যায়, কারণ ফলটি খুবই সংবেদনশীল ও সংরক্ষণ কঠিন।
সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা:
যদিও মিরাকল ফ্রুট নিরাপদ, অতিরিক্ত খেলে বা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে মুখের স্বাভাবিক স্বাদগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্থায়ী বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। এছাড়া অম্লীয় খাবারকে মিষ্টি মনে হলেও, সেগুলোর এসিড দাঁতের ক্ষয় বা মুখের জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সাবধানে খাওয়া উচিত।
মিরাকল ফ্রুট প্রমাণ করেছে, প্রকৃতির ল্যাবরেটরিতে এখনো লুকিয়ে আছে এমন সব রহস্য, যা মানুষের ইন্দ্রিয়ের সীমাকেও চ্যালেঞ্জ করে।
এই ছোট লাল ফল শুধু টককে মিষ্টি করে না। এটি আমাদের শেখায়, দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেই বাস্তবতাও বদলে যেতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।