টক-মিষ্টির জাদু! স্যানটল খেলে হজমও হয় ম্যাজিকের মতো দক্ষিণ এশিয়ার গোপন সুপারফুড

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ায় একটি অচেনা অথচ আশ্চর্যজনক ফল চুপিসারে জায়গা করে নিচ্ছে স্যানটল (Santol)। গোলাকৃতি, সোনালি-বাদামি রঙের এই ফলটি দেখতে কিছুটা আমলকী বা ছোট জামরুলের মতো হলেও স্বাদে সম্পূর্ণ আলাদা। টক আর মিষ্টির মাঝামাঝি এই ফলের গন্ধে রয়েছে এক ধরণের সতেজতা, যা একবার খেলে সহজে ভুলে থাকা যায় না।
স্যানটল ফল মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস ও মালয়েশিয়া অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। তবে এখন এটি দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
স্যানটল গাছ দেখতে অনেকটা আমগাছের মতো উঁচু, ছায়া-দায়ক ও বছরের বেশিরভাগ সময় সবুজে ঢাকা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Sandoricum koetjape, যা Meliaceae পরিবারভুক্ত। ফলটি সাধারণত ৫–৭ সেন্টিমিটার ব্যাসের হয়। বাইরের খোসা পুরু ও হালকা কষযুক্ত, ভেতরে তুলোর মতো নরম শাঁস যার ভেতর কয়েকটি বাদামি শক্ত বীজ থাকে। এই সাদা তুলোর মতো শাঁসই মূল ভক্ষণযোগ্য অংশ। এর স্বাদ কখনো মিষ্টি, কখনো টক, কখনো হালকা কষযুক্ত অবস্থার উপর নির্ভর করে।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতিটি ১০০ গ্রাম স্যানটলে থাকে আনুমানিক:
⇨ ভিটামিন সি: ৩০–৪০ মিলিগ্রাম (রোগপ্রতিরোধ ও ত্বকের যত্নে সহায়ক)
⇨ ডায়েটারি ফাইবার: প্রায় ৩–৪ গ্রাম (হজম ও অন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ)
⇨ ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস: হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক
⇨ আয়রন: রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে
⇨ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েডস: কোষের ক্ষয় রোধে ভূমিকা রাখে
এছাড়াও এতে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান, যা শরীরের কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে।
স্যানটলের সবচেয়ে বড় গুণ হলো এর হজমে সহায়ক ভূমিকা। ফলটির ফাইবার হজমতন্ত্রে একটি প্রাকৃতিক ক্লিনজারের মতো কাজ করে।
১. অন্ত্রের গতি বাড়ায়: এতে থাকা ইনসলিউবল ফাইবার অন্ত্রের বর্জ্য দ্রুত নির্গত করতে সাহায্য করে, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে।
২. হজম এনজাইম উদ্দীপিত করে: স্যানটলের টক উপাদান পাকস্থলীতে গ্যাস্ট্রিক জুসের নিঃসরণ বাড়ায়, যা প্রোটিন ও চর্বি ভাঙতে সাহায্য করে।
৩. গ্যাস্ট্রিকের ভারসাম্য বজায় রাখে: অনেক সময় অতিরিক্ত অম্লতা বা অ্যাসিডিটি হজমে সমস্যা তৈরি করে স্যানটলের প্রাকৃতিক জৈব অ্যাসিড (যেমন citric acid ও malic acid) পাকস্থলীর pH ব্যালান্স ধরে রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পরিমিত স্যানটল খায়, তাদের হজমতন্ত্রে ফাইবারের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং bloating বা indigestion কম হয়।
স্বাস্থ্যগুণের আরও কিছু দিক-
⇨ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: ভিটামিন সি ও ফেনল যৌগ শরীরকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।
⇨ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর: এটি ফ্রি র্যাডিকেল কমিয়ে ত্বকের কোষকে সুরক্ষা দেয় ফলে বার্ধক্য বিলম্বিত হয়।
⇨ রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক: ফাইবার রক্তে গ্লুকোজের শোষণ ধীর করে, ফলে রক্তচাপ ও সুগারের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
⇨ ত্বক ও চুলের যত্নে: ভিটামিন সি ও খনিজ উপাদান কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে, যা ত্বককে উজ্জ্বল ও চুলকে মজবুত রাখে।
✪ সতর্কতা:
যদিও স্যানটল পুষ্টিকর, তবে ফলের বীজ কখনোই গিলে ফেলা উচিত নয়। বীজটি শক্ত ও হজমে অক্ষম। এটি অন্ত্রে আটকে গিয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত খেলে টক উপাদান পাকস্থলীতে অস্বস্তি বা অ্যাসিডিটি তৈরি করতে পারে। তাই দিনে ১–২টি ফলই যথেষ্ট।
খাওয়ার উপায় ও ব্যবহার:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্যানটল সাধারণত দুইভাবে খাওয়া হয়
◑ কাঁচা অবস্থায়: লবণ, মরিচ বা চিনি মিশিয়ে টক-মিষ্টি চাটনির মতো করে।
◑ রান্নায় বা জ্যামে: এর শাঁস জ্যাম, শরবত বা টক-মিষ্টি আচার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অনেকে শুকিয়ে গুঁড়ো করে প্রাকৃতিক পানীয়তেও ব্যবহার করেন।
প্রকৃতির অগণিত ফলের ভিড়ে স্যানটল এখনো অচেনা, অথচ এর পুষ্টিগুণ ও হজমে ভূমিকা একেবারে প্রমাণিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিযুক্ত। এতে একদিকে রয়েছে স্বাদের সতেজ টক-মিষ্টি আনন্দ, অন্যদিকে হজমে সহায়ক প্রাকৃতিক চিকিৎসা। হয়তো আমাদের দেশে এই ফল এখনো সহজলভ্য নয়, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রাচীন ফলটি ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। কারণ বিজ্ঞান বলছে, প্রকৃতির এই টক-মিষ্টি উপহার সত্যিই শরীরের ভারসাম্য রক্ষার এক সহজ উপায়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।