তেলের ওপর নির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতি,নিরাপত্তার খামি এবং ঝুঁকির হিসাব!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের বিশ্ব অর্থনীতি তেলের সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে যুক্ত যে, এর ওপর নির্ভরশীলতা শুধু জ্বালানি খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। শিল্প, পরিবহন, কৃষি, এবং এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সবকিছু তেলের ওপর নির্ভরশীল। তেল বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত পেট্রোডলার আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের পেট্রোডলারের অভ্যন্তরীণ নীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলেও ঝুঁকিমুক্ত নয়।
পেট্রোডলার বলতে বোঝায় তেল বিক্রয় থেকে অর্জিত ডলার, যা বিশ্ব বাজারে বিনিয়োগ বা রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই ডলার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, বন্ড বা ব্যাংক রিজার্ভে রাখে। পেট্রোডলারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের আধিপত্য বজায় থাকে। এতে তেলের মূল্য ওঠা-নামা বা রাজনৈতিক ঝুঁকি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হলেও, এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে একধরনের "পেট্রোডলার ফ্রেমওয়ার্ক"-এর মধ্যে আবদ্ধ করে।
পেট্রোডলারের ওপর নির্ভরশীলতার ঝুঁকি:
১. তেলের মূল্য ওঠা-নামা: ২০২০ সালে কোভিড মহামারির সময় তেলের দাম নেতিবাচক পর্যায়ে নেমেছিল। এমন ওঠা-নামা মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ অস্থিরতা ও জ্বালানি খাতের ব্যর্থতা তৈরি করে।তেলের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর বাজেট ও আর্থিক নীতি এই ওঠা-নামার সঙ্গে সরাসরি প্রভাবিত হয়।
২. রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ঝুঁকি: মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা বা সংঘাত পেট্রোডলারের প্রবাহকে হ্রাস করতে পারে। যখন তেলের সরবরাহ ব্যাহত হয়, তখন বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি বিশেষ করে তেলের ভোক্তা দেশ অত্যন্ত অস্থির হয়ে যায়।
৩. ডলারের একপাশের নির্ভরশীলতা: পেট্রোডলারের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি মূলত ডলারের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন মুদ্রানীতি পরিবর্তন হলে তেলের বাজারে থাকা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়ার অর্থনীতি ডলারের ওঠা-নামার সঙ্গে সরাসরি প্রভাবিত হয়।
৪. পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত ঝুঁকি: তেল ব্যবহার ও উৎপাদন পরিবেশে প্রভাব ফেলে, যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিল্প খাতের স্থিতিশীলতা প্রভাবিত করে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির বিকল্প না থাকলে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়তে পারে।
ঝুঁকি হ্রাসের সম্ভাব্য পদক্ষেপ-
⇨ বিকল্প শক্তি উৎসে বিনিয়োগ: সৌর, বায়ু ও হাইড্রোজেন শক্তি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়ক।
⇨ মুদ্রার বৈচিত্র্য: ইউরো, SDR বা স্থানীয় মুদ্রায় তেলের বাণিজ্য করা ডলারের একপাশের চাপ কমায়।
⇨ পেট্রোডলারের আংশিক বিকল্প: তেলের বিক্রয়কে স্থানীয় মুদ্রায় বা ক্রিপ্টো-ভিত্তিক চুক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে।
⇨ বৈশ্বিক নীতি সমন্বয়: আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত নীতি বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
বৈশ্বিক প্রভাব-
◑ মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগ অস্থিরতা: তেলের মূল্যের ওঠা-নামা সরাসরি বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলে।
◑ বাজেট ও ঋণ: তেলের ওপর নির্ভরশীল দেশের বাজেট ঘাটতি বা ঋণ বৃদ্ধি হতে পারে।
◑ খাদ্য ও জ্বালানি: তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পায়।
◑ অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: পেট্রোডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বিশ্ব বাজারে সম্ভাব্য অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি করে।
পেট্রোডলার বিশ্ব অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত্তি, যা তেলের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।
তেলের মূল্যের ওঠা-নামা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ডলারের ওপর একপাশের নির্ভরশীলতা—সবই বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে রাখে। বিকল্প শক্তি, বৈচিত্র্যময় মুদ্রা ও আন্তর্জাতিক নীতি সমন্বয় ছাড়া এই নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, পেট্রোডলার আধিপত্য শক্তিশালী হলেও এর সাথে আসা ঝুঁকি ও অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রাখে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।