হিমালয় ও পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ কি বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ! জানেন কি?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষ যেমন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য নিজেকে মানিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি পাহাড়ি অঞ্চলের গাছপালাও নিজেদের রক্ষা করার জন্য গড়ে তোলে এক বিস্ময়কর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষার মূল রহস্য হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমালয় কিংবা অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় জন্মানো গাছপালার মধ্যে সমতলভূমির গাছের তুলনায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যৌগের ঘনত্ব অনেক বেশি, আর এর পেছনে রয়েছে পরিবেশগত চরমতা, সূর্যালোকের তীব্রতা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপের জটিল সম্পর্ক।
উচ্চতায় সূর্যের রশ্মি বেশি, তাই রক্ষা প্রয়োজন আরও বেশি! পাহাড়ি অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা যত বাড়ে, ততই পাতলা হয় বায়ুমণ্ডল। ফলে সূর্যের অতিবেগুনি (UV) রশ্মি সেখানে অনেক বেশি শক্তিশালীভাবে গাছের ওপর পড়ে।
এই রশ্মি কোষের ডিএনএ ক্ষতি করতে পারে, প্রোটিন ও লিপিড ভেঙে দেয় যা উদ্ভিদের জন্য বিপজ্জনক। ফলে গাছগুলো নিজেদের রক্ষা করতে তৈরি করে ফ্ল্যাভোনয়েড, পলিফেনল, ট্যানিন, ক্যারোটিনয়েড ইত্যাদি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যৌগ, যা সূর্যালোকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কোষকে বাঁচায়। সহজভাবে বলতে গেলে যত বেশি রোদ, তত বেশি "প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা" আর সেই প্রতিরক্ষাই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট।
ঠান্ডা তাপমাত্রা ও অক্সিডেটিভ চাপ- উচ্চ পাহাড়ে তাপমাত্রা অনেক কম, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও কম। এই পরিবেশে গাছের কোষে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিজ (ROS) নামের ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়, যা কোষের ক্ষতি করতে পারে। তাই বেঁচে থাকার জন্য গাছগুলো অতিরিক্ত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এনজাইম উৎপাদন করে। যেমন সুপারঅক্সাইড ডিসমিউটেজ (SOD), ক্যাটালেজ, গ্লুটাথায়োন পেরঅক্সিডেজ ইত্যাদি। এই এনজাইমগুলো কোষের ভেতরে রাসায়নিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে, যেন গাছের টিস্যুগুলো ঠান্ডা ও অক্সিজেনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
উচ্চতা ও বাতাসের চাপের প্রভাব-
উচ্চ পাহাড়ি এলাকায় বায়ুচাপ কম থাকায় জলীয় বাষ্পের পরিমাণও কম। ফলে বাতাসে আর্দ্রতা কমে যায়, যা গাছের জন্য একধরনের শুষ্কতা বা 'স্ট্রেস'। এই অবস্থায় গাছ নিজের কোষে প্রোটেকটিভ মলিকিউলস তৈরি করে, যা শুধু জলধারণেই সাহায্য করে না, একই সঙ্গে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। এগুলোই পরে মানুষের জন্য পুষ্টিকর যৌগ হিসেবে পরিচিত হয়।
হিমালয় অঞ্চলের উদ্ভিদের বিশেষত্ব-
হিমালয় অঞ্চলে পাওয়া রডিওলা, জুনিপার, গিনসেং, তুলসী, রোডোডেনড্রন, গ্রিন টি প্ল্যান্ট ইত্যাদি গাছপালা এত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যে, সেগুলোর নির্যাস আজ বিশ্বের নানা দেশে ওষুধ ও স্কিনকেয়ার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব গাছের মধ্যে থাকা পলিফেনল ও অ্যাডাপ্টোজেনিক যৌগ মানবদেহে কোষের বয়স ধীর করে, প্রদাহ কমায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
পাহাড়ি উদ্ভিদে UV রশ্মির সঙ্গে সম্পর্কিত জিনগুলোর সক্রিয়তা বেশি, যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। জলবায়ু-উদ্ভিদ সম্পর্ক (Eco-physiology) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উচ্চতায় জন্মানো গাছের পাতায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মাত্রা প্রায় ১.৫–২ গুণ বেশি। হিমালয়ের গাছের নির্যাসে থাকা ফেনলিক কম্পাউন্ড ফ্রি র্যাডিকেল নিরপেক্ষ করার ক্ষমতা সাধারণ গাছের তুলনায় অনেক শক্তিশালী।
পাহাড়ি গাছপালার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শক্তি কোনো অলৌকিক বিষয় নয়,এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক অভিযোজন। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, ঠান্ডা হাওয়া, অক্সিজেনের স্বল্পতা আর কঠোর পরিবেশ মিলে গাছগুলোকে বাধ্য করেছে নিজেদের রক্ষার জন্য আরও শক্তিশালী রাসায়নিক প্রতিরক্ষা তৈরি করতে। ফলে যখন আমরা হিমালয়ের কোনো ভেষজ বা চা পান করি, তখন আসলে আমরা গ্রহণ করি প্রকৃতির সেই টিকে থাকার শক্তিরই এক ছোট অংশ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।