যে দেশ কখনো উপনিবেশ হয়নি জানলে হতাশ হবেন ইতিহাসপ্রেমীরা!

যে দেশ কখনো উপনিবেশ হয়নি জানলে হতাশ হবেন ইতিহাসপ্রেমীরা!
ছবির ক্যাপশান, যে দেশ কখনো উপনিবেশ হয়নি জানলে হতাশ হবেন ইতিহাসপ্রেমীরা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বিশ্ব ইতিহাসে এক সময় এমন এক অধ্যায় ছিল যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে তাদের পতাকা পেড়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ এই পাঁচ সাম্রাজ্যিক শক্তির দখলদারিত্বে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা পরিণত হয়েছিল বিশাল উপনিবেশে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় - এই দীর্ঘ সাম্রাজ্যিক ঝড়ের মাঝেও দুটি দেশ তাদের স্বাধীনতার আলো নিভতে দেয়নি। তারা হলো থাইল্যান্ড ও ভুটান। এই দুটি দেশের গল্প শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি বুদ্ধি, কৌশল ও সংস্কৃতির এমন এক অধ্যয়ন, যা এখনো বিশ্ব রাজনীতির পাঠ্যবইয়ে স্থান পায় স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে।

থাইল্যান্ড, কূটনীতির প্রজ্ঞায় টিকে থাকা স্বাধীনতার মুকুট!

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হৃদয়ে অবস্থিত থাইল্যান্ড (পুরনো নাম সিয়াম)। চারপাশে উপনিবেশিত দেশ এক পাশে ফরাসি শাসিত লাওস ও কম্বোডিয়া, অন্য পাশে ব্রিটিশ দখল করা বার্মা ও মালয়েশিয়া। তবু মাঝখানে থাকা ছোট্ট এই দেশটি কীভাবে শত বছরের সাম্রাজ্যিক চাপে টিকে গেল?

যুদ্ধ নয়, বুদ্ধির রাজনীতি! ১৮৫১ সালে সিংহাসনে বসেন রাজা মংকুট (রামা চতুর্থ)। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী কিন্তু তার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। তিনি বুঝেছিলেন, ইউরোপীয় শক্তিকে ঠেকানো অসম্ভব, কিন্তু তাদের ভারসাম্য বজায় রাখলে বাঁচা সম্ভব। সেই সময় তিনি ও পরবর্তী রাজা চুলালংকর্ন (রামা পঞ্চম) এক অনন্য নীতি গ্রহণ করেন "Give a little, save the whole." তারা সীমান্তের কিছু অঞ্চল ফরাসি ও ব্রিটিশদের কাছে ছাড়েন, কিন্তু এর বিনিময়ে স্বীকৃতি পান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে।

রাজা চুলালংকর্নের সময়েই থাইল্যান্ডে শিক্ষা, রেলপথ, ডাক ব্যবস্থা, আধুনিক বিচারব্যবস্থা ও দাসপ্রথা বিলোপের মতো সংস্কার আসে। এগুলো শুধু উন্নয়ন নয় এগুলো ছিল বিদেশি শক্তির চোখে থাইল্যান্ডকে "সভ্য ও সক্ষম" রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার কৌশল।

ফলে ইউরোপীয় শক্তি এই দেশটিকে দখল করার চেয়ে সহযোগিতার অংশীদার বানানোই অধিক লাভজনক মনে করে।

থাইল্যান্ডের এই কূটনীতি আজও রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটিকে "Buffer State Diplomacy" বলা হয় যেখানে দুটি পরাশক্তির মাঝখানে থেকে কোনো পক্ষের অধীন না হয়ে উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা হয়। আজও থাইল্যান্ডের জনগণ গর্ব করে বলে "We lost some land, but never our freedom."

এমন বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলই তাদেরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে উপনিবেশ-মুক্ত রেখেছে।

ভুটান, হিমালয়ের কোলে স্বাধীনতার নীরব দুর্গ!

যেখানে থাইল্যান্ড কূটনীতিতে জয়ী, সেখানে ভুটান জিতেছে ভূগোল, সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণে।

হিমালয়ের কোলের এই ছোট্ট রাজ্য কখনোই ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণ উপনিবেশ হয়নি, যদিও একসময় ছিল ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট (সুরক্ষিত রাজ্য)।

ভুটানকে বলা হয় "Land of the Thunder Dragon" ঝড়ের ড্রাগনের দেশ।

দেশটি এতই দুর্গম, পাহাড়ি ও ঘন বনাঞ্চলপূর্ণ যে ব্রিটিশ সৈন্যদের পক্ষে পূর্ণ দখল নেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।

উচ্চতা, শীতল জলবায়ু এবং জটিল ভূসংস্থান ভুটানকে এক প্রাকৃতিক দুর্গে পরিণত করেছিল।

১৮৬৫ সালের সিনচুলা চুক্তির মাধ্যমে ভুটান কিছু ভূখণ্ড ব্রিটিশদের দেয়, বিনিময়ে পায় অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। অর্থাৎ, ব্রিটিশরা তাদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও ভুটানের রাজারা দেশের ভেতরের রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এই চুক্তিই ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যেখানে ভুটান প্রমাণ করে স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিকও।

ভুটান নিজেকে কখনোই পশ্চিমা ধাঁচে আধুনিক করতে দেয়নি, বরং নিজের অনন্য বৌদ্ধ-সংস্কৃতি ও দর্শনের মধ্যে গড়ে তোলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ।

ভুটানের উন্নয়ন ধারণা "গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস" (GNH) আজ বিশ্বজুড়ে আলোচিত।

এই নীতিতে জিডিপির পরিবর্তে দেশের সুখ, মানসিক শান্তি, পরিবেশ, ও সামাজিক ভারসাম্যকেই উন্নয়নের সূচক ধরা হয়। এটি তাদের স্বাধীন চিন্তারই প্রতিফলন যেখানে ভোগবাদ নয়, বরং মানসিক তৃপ্তিকেই রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির মাপকাঠি বানানো হয়েছে।

থাইল্যান্ড ও ভুটানের কাহিনি আমাদের শেখায়

স্বাধীনতা রক্ষায় সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো চিন্তা, সংস্কৃতি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। শক্তিশালী সেনাবাহিনী নয়, বরং দূরদৃষ্টি ও ঐক্যই একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আর স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি এক মানসিক অবস্থান নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ও সংস্কৃতির অখণ্ডতা রক্ষার নামই স্বাধীনতা।

যখন বিশ্বজুড়ে উপনিবেশবাদের ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল, তখন মেকং নদীর তীরে ও হিমালয়ের চূড়ায় দুটি জাতি নিঃশব্দে লিখেছিল ইতিহাসের ব্যতিক্রমী অধ্যায়।

তারা যুদ্ধ করেনি, তারা আত্মসমর্পণও করেনি, তারা বেছে নিয়েছিল বুদ্ধি, সংস্কৃতি ও আত্মবিশ্বাসের পথ। আজও থাইল্যান্ড ও ভুটান বিশ্বের কাছে সেই বার্তা দেয় "স্বাধীনতা কখনো উপহার নয়, এটি প্রজ্ঞা ও ঐক্যের দ্বারা অর্জিত এক অবিচল সাধনা।"

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ