এক কোড, এক বিপ্লব! দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের ভবিষ্যতের শিক্ষার মানচিত্র কি এবার পাল্টাচ্ছে?

এক কোড, এক বিপ্লব! দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের ভবিষ্যতের শিক্ষার মানচিত্র কি এবার পাল্টাচ্ছে?
ছবির ক্যাপশান, এক কোড, এক বিপ্লব! দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের ভবিষ্যতের শিক্ষার মানচিত্র কি এবার পাল্টাচ্ছে?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা নীতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দিকেই এগোচ্ছে সময়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানসহ সমগ্র অঞ্চলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কমন কোডিং কারিকুলাম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেখানে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হবে "প্রযুক্তির ভাষা"। এ উদ্যোগের লক্ষ্য একটাই শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তোলা যেন তারা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারকারী নয়, বরং প্রযুক্তি সৃষ্টিকারী হয়ে উঠতে পারে।

বিগত দশকে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ফোকাস বদলে গেছে। আগে যেখানে "জ্ঞান মুখস্থ করা" ছিল প্রধান লক্ষ্য, এখন সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে "সমস্যা সমাধান ও সৃজনশীল চিন্তা"। বিশ্ব অর্থনীতি যখন দ্রুত অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও ডেটা প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে, তখন কোডিং হয়ে উঠেছে নতুন সাক্ষরতা, যেমন - একসময় ইংরেজি ভাষা ছিল।

দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি অঞ্চল। এখানে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বছরের নিচে। এই বিশাল তরুণ সমাজকে যদি প্রযুক্তি-সক্ষম করে তোলা যায়, তবে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিতে পারে। এই কারণেই আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে - কোডিং ও ডিজিটাল স্কিল এখন আর ঐচ্ছিক নয়, বরং "মূল শিক্ষা কাঠামোর" অংশ হওয়া দরকার।

নতুন এই কারিকুলামটি শিশুদের মানসিক বিকাশ, শেখার ধরন ও বয়স অনুযায়ী তিনটি ধাপে বিভক্ত হবে:

১. প্রাথমিক স্তর (৬–১০ বছর): এই পর্যায়ে শিশুদের শেখানো হবে কম্পিউটেশনাল থিংকিং অর্থাৎ সমস্যা ভেঙে চিন্তা করা, ধাপে ধাপে সমাধান খোঁজা, এবং যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

শিক্ষার্থীরা ভিজ্যুয়াল প্রোগ্রামিং টুল (যেমন Scratch বা Blockly) ব্যবহার করে ছোট গেম, গল্প বা অ্যানিমেশন বানিয়ে শেখবে কিভাবে একটি ধারণাকে কোডে রূপ দিতে হয়।

এই পর্যায়ে মূল লক্ষ্য থাকবে "প্রযুক্তিতে আগ্রহ" জাগানো এবং "সৃজনশীল চিন্তা" গড়ে তোলা।

২. মাধ্যমিক স্তর (১১–১৫ বছর): এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা প্রোগ্রামিংয়ের মূল ভাষাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবে যেমন Python বা JavaScript।

তাদের শেখানো হবে কিভাবে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে কোড ব্যবহার করা যায়, যেমন একটি গ্রাম্য কৃষককে সহায়তা করার জন্য আবহাওয়ার তথ্যভিত্তিক অ্যাপ তৈরি, বা স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ।

এখানে গুরুত্ব থাকবে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষায়, যাতে শিশু নিজের হাতে "কিছু তৈরি করার আনন্দ" অনুভব করতে পারে।

৩. উচ্চ মাধ্যমিক স্তর (১৬–১৮ বছর): এ স্তরে যুক্ত হবে ডেটা বিশ্লেষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ধারণা, ও ওয়েব/অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের বেসিক পাঠ।

শিক্ষার্থীরা নিজেদের তৈরি প্রজেক্ট উপস্থাপন করবে, যা স্থানীয় সমস্যা সমাধান বা সামাজিক উদ্যোগে কাজে লাগবে।

এই ধাপে কোডিং হয়ে উঠবে শুধু প্রযুক্তি শেখা নয়, বরং চিন্তার একটি পদ্ধতি- একটি মানসিক শৃঙ্খলা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শিক্ষা মান, সম্পদ ও অবকাঠামোয় ভিন্ন হলেও একটি অভিন্ন কোডিং কাঠামো তাদের প্রযুক্তিগত সামঞ্জস্য আনতে সাহায্য করবে।

এই উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি হবে একটি আঞ্চলিক মানবসম্পদ পুল, যারা একই মানের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রোগ্রামাররা একসঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এছাড়া, অভিন্ন পাঠ্যক্রম তৈরি করলে দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়বে যেমন কোডিং অলিম্পিয়াড, ক্রস-কান্ট্রি প্রজেক্ট, বা ভার্চুয়াল ক্লাস এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামে "ডিজিটাল লিটারেসি" অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব ও স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি হচ্ছে।

তবে এখনো শহর-গ্রাম বৈষম্য, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ঘাটতি, এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বড় চ্যালেঞ্জ।

নতুন কমন কারিকুলাম কার্যকর করতে হলে দরকার:

⇨ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সহজতর কোডিং মডিউল

⇨ স্থানীয় ভাষায় কোডিং শেখানোর উপকরণ

⇨ ইন্টারনেট ও ডিভাইস অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা

⇨ মেয়েশিশুদের অংশগ্রহণ বাড়ানো

⇨ বাংলাদেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোডিং শেখানোর বিষয়টি শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং "চিন্তা শেখানো" এবং সেটিই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোডিং শেখা শিশুদের "মেটাকগনিশন" বা নিজের চিন্তাভাবনা বোঝার ক্ষমতা বাড়ায়।

তারা যখন একটি সমস্যা সমাধানের জন্য ধাপে ধাপে চিন্তা করে, তখন মস্তিষ্কের বিশ্লেষণাত্মক অংশ সক্রিয় হয়, যা পরবর্তীতে গণিত, ভাষা ও যুক্তিবিদ্যায় দক্ষতা বাড়ায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলা থেকে কোডিং শেখে, তারা সিদ্ধান্ত নিতে দ্রুত, দলগতভাবে কাজ করতে দক্ষ এবং ব্যর্থতাকে ভয় পায় না। কারণ কোডিং শেখায় "বারবার ভুল করে শেখা"র মানসিকতা।

কোডিং কেবল একটি টেকনিক্যাল দক্ষতা নয়; এটি ভবিষ্যতের নৈতিক ও মানবিক সমাজ গঠনের মাধ্যমও হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি যেখানে সহযোগিতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেখানে কোডিং শিক্ষা সেই মূল্যবোধকেও প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করছে। একটি শিশুর তৈরি করা ছোট অ্যাপ যদি তার সমাজের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে, তাহলে সেটিই শিক্ষার প্রকৃত সার্থকতা। এভাবে প্রযুক্তি হয়ে উঠবে মানবতার হাতিয়ার, আর দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠবে সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু।

আগামী দশকে যেসব পেশা টিকে থাকবে, তার অধিকাংশই প্রযুক্তিনির্ভর হবে।

কোডিং শেখা মানে ভবিষ্যতের দরজায় আগেভাগে কড়া নাড়া একটি এমন দক্ষতা, যা ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে মানুষকে এক করে ফেলে।

দক্ষিণ এশিয়ার এই অভিন্ন কোডিং কারিকুলাম হয়তো শুধু একটি শিক্ষা উদ্যোগ নয়;

এটি হতে পারে প্রজন্মান্তরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা, যেখানে প্রতিটি শিশু বুঝবে প্রযুক্তি শুধু শেখার নয়, তৈরি করার বিষয়ও।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ