সিদ্ধান্তহীনতা কি শুধু আপনারই সমস্যা? মস্তিষ্কের ভেতরের আসল কাহিনী এখানে! জানুন!

সিদ্ধান্তহীনতা কি শুধু আপনারই সমস্যা? মস্তিষ্কের ভেতরের আসল কাহিনী এখানে! জানুন!
ছবির ক্যাপশান, সিদ্ধান্তহীনতা কি শুধু আপনারই সমস্যা? মস্তিষ্কের ভেতরের আসল কাহিনী এখানে! জানুন!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমরা প্রতিদিন ছোট-বড় শত শত সিদ্ধান্ত নেই সকালের নাশতায় কী খাব, অফিসে কোন কাজ আগে করব, এমনকি জীবনের বড় সিদ্ধান্ত পেশা, সম্পর্ক বা ভবিষ্যৎ পথ বেছে নেওয়ার বিষয়েও। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যখন আমরা "দোলাচলে" পড়ি, অর্থাৎ ঠিক করতে পারি না কী করা উচিত, তখন আসলে মস্তিষ্কের ভেতরে কী ঘটে?

বিজ্ঞান বলছে সিদ্ধান্তহীনতা কেবল মানসিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি মস্তিষ্কের একধরনের জৈব-রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া।

চলুন দেখি ধাপে ধাপে, আমাদের মস্তিষ্ক তখন কীভাবে কাজ করে-

১. সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন্দ্র, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex):

মস্তিষ্কের সামনের অংশে থাকা prefrontal cortex হলো আমাদের চিন্তা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। যখন আমরা কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবি যেমন "এই চাকরিটা নেব কি না?", "আজই ফোন করব নাকি কাল?" তখন এই অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এই অঞ্চল সম্ভাব্য প্রতিটি বিকল্পের লাভ-ক্ষতি, ঝুঁকি ও পরিণতি হিসাব করে।

কিন্তু বিকল্প যত বাড়ে, এই কেন্দ্র তত বেশি তথ্য প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্নায়বিক জটিলতা তৈরি হয়। এটাই "analysis paralysis" অতিরিক্ত চিন্তায় সিদ্ধান্ত আটকে যাওয়া।

২. দ্বন্দ্বের উৎস,অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (Anterior Cingulate Cortex):

এই অংশের কাজ হলো বিকল্পগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বা অস্পষ্টতা শনাক্ত করা। যখন দুটি বিকল্প প্রায় সমান ভালো বা খারাপ মনে হয়, তখন এটি "কোনটা বেছে নেওয়া উচিত" তা নির্ধারণে হিমশিম খায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সিদ্ধান্তহীন মানুষের এই অংশে বেশি স্নায়বিক কার্যকলাপ হয়, যা মানসিক চাপ ও অনিশ্চয়তার অনুভূতি বাড়ায়। এই অবস্থায় শরীরেও কর্টিসল নামক "স্ট্রেস হরমোন" বাড়ে, ফলে আমরা অস্থির বা মানসিকভাবে ক্লান্ত বোধ করি।

৩. আবেগ বনাম যুক্তি, অ্যামিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সংঘর্ষ:

প্রত্যেক সিদ্ধান্তে যুক্তির পাশাপাশি আবেগও বড় ভূমিকা রাখে। এখানে মূল ভূমিকায় থাকে অ্যামিগডালা (amygdala), যা ভয়ের, ঝুঁকির বা আনন্দের সংকেত দেয়। যখন কোনো বিকল্প ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, অ্যামিগডালা সতর্ক সংকেত পাঠায় "না, এটা বিপজ্জনক হতে পারে।" অন্যদিকে, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স যুক্তির ভিত্তিতে বলে "না, ঝুঁকি থাকলেও সুযোগও আছে।"

এই দুই অংশের মধ্যে টানাপোড়েনই অনেক সময় সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দেয়।

এই দ্বন্দ্ব যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানসিক চাপ তত বাড়ে এবং মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে "অচল" হয়ে পড়ে, যেন নিজেই বলে ওঠে, "এখন কিছু না করাই ভালো।"

৪. ডোপামিন ও অনিশ্চয়তার আনন্দ–ভয়!

আমরা জানি না কোন সিদ্ধান্ত সঠিক এই অনিশ্চয়তা মস্তিষ্কের জন্য একদিকে উত্তেজনাপূর্ণ, আবার অন্যদিকে চাপেরও উৎস। এ সময় ডোপামিন নামক "মোটিভেশন হরমোন" ওঠানামা করে।

যখন মস্তিষ্ক মনে করে কোনো সিদ্ধান্তে সম্ভাব্য পুরস্কার (reward) আছে, তখন ডোপামিন বেড়ে যায়, আমরা উৎসাহ পাই। কিন্তু সেই পুরস্কার যদি নিশ্চিত না হয়, ডোপামিন কমে যায়, আর মস্তিষ্ক বলে "অপেক্ষা করো, আরও ভাবো।" ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি।

৫. সিদ্ধান্তহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হলে কী হয়!

যদি বারবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় বা অনিশ্চয়তা লেগে থাকে, মস্তিষ্কে কয়েকটি পরিবর্তন দেখা যায়

⇨ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সক্রিয়তা কমে যায়, বিশ্লেষণ ক্ষমতা দুর্বল হয়

⇨ অ্যামিগডালার নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যায়, ফলে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ে

⇨ মনোযোগ কমে, আত্মবিশ্বাস ক্ষয় হয়

⇨ অতীত সিদ্ধান্তের ভুলগুলো মস্তিষ্কে বেশি জোরে "পুনরাবৃত্তি" হয় ফলে আবার নতুন সিদ্ধান্তে ভয় তৈরি হয়

⇨ এভাবেই "indecision loop" তৈরি হয়। একবার সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেলে, পরের বার আরও কঠিন হয়ে যায়।

৬. মস্তিষ্ককে সিদ্ধান্তে সাহায্য করার কৌশল:

গবেষণা বলছে, মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। কিছু কার্যকর উপায় হলো

⇨ছোট সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করুন: মস্তিষ্ক ছোট সিদ্ধান্তে সাফল্য পেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

⇨ সময়সীমা নির্ধারণ করুন: দীর্ঘ সময় ভাবলে মস্তিষ্ক তথ্যের ভারে আটকে যায়।

⇨ বিকল্প সীমিত রাখুন: তিনটির বেশি বিকল্প দিলে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের চাপ বাড়ে।

⇨ বিশ্রাম নিন বা হাঁটুন: বিশ্রামে থাকা অবস্থায় মস্তিষ্ক default mode network-এর মাধ্যমে অবচেতনভাবে সমাধান খোঁজে।

⇨ আবেগ স্বীকার করুন: ভয় বা সন্দেহ অস্বীকার না করে তাদের পর্যবেক্ষণ করুন এতে অ্যামিগডালার নিয়ন্ত্রণ কমে।

সিদ্ধান্তহীনতা কোনো দুর্বলতা নয় এটি একধরনের জৈব প্রতিক্রিয়া, যেখানে মস্তিষ্ক যুক্তি ও আবেগের ভারসাম্য খোঁজে। যখন আমরা নিজেদের সময় দিই, বিকল্প সীমিত রাখি এবং ভয়কে মেনে নেই, তখন মস্তিষ্ক আবার স্থিতিশীল ছন্দে ফিরে আসে। এক কথায়- সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে মস্তিষ্ককে জোর করে "হ্যাঁ" বলানো নয়, বরং তাকে স্পষ্টতা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ