এক টুকরো সবুজেই যেভাবে বদলে যেতে পারে আপনার ব্যস্ত জীবনের ছন্দ!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের নগরজীবন মানেই ব্যস্ততা, শব্দদূষণ, ধোঁয়া আর মানসিক চাপের এক নিরবচ্ছিন্ন চক্র। সারাদিনের কাজের শেষে যখন শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন, তখন সামান্য একটা বারান্দা, কয়েকটি টব, আর কিছু সবুজ গাছের উপস্থিতি হয়ে ওঠে আশ্রয়স্থল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের মস্তিষ্ক প্রকৃতির রঙের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। সবুজ রঙ চোখ ও স্নায়ুর ওপর শান্ত প্রভাব ফেলে, হৃদস্পন্দন কমায়, এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এজন্যই ব্যস্ত নগরবাসীর কাছে এই সামান্য সবুজ মানেই মানসিক আরাম, প্রশান্তি এবং ইতিবাচকতার পুনর্জন্ম।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, সবুজ গাছের উপস্থিতি কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ কমায়,যা আমাদের স্ট্রেসের জন্য দায়ী। গাছের দিকে তাকিয়ে কয়েক মিনিট সময় কাটানোও মস্তিষ্কে এক ধরণের "রেস্টোরেটিভ ইফেক্ট" সৃষ্টি করে, যা ক্লান্ত মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করে।
⇨ মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব: গাছের সান্নিধ্য বা বাগান করার মতো কাজ মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে, মনোযোগের ঘাটতি (Attention Fatigue) কমায় এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়।
গাছের যত্ন নেওয়া এক ধরনের মনোযোগী প্রক্রিয়া (Mindful Activity), যা মস্তিষ্ককে বর্তমানে স্থির রাখে, একইভাবে যেভাবে মেডিটেশন কাজ করে।
⇨ বিষণ্ণতা কমানো: নিয়মিত গাছের পরিচর্যা, মাটি ছোঁয়া, পানি দেওয়া এসব কাজ শরীরে সেরোটোনিন হরমোন বাড়ায়, যা 'হ্যাপিনেস হরমোন' নামে পরিচিত। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বারান্দার বাগান এক ধরণের "গ্রিন থেরাপি", যা হতাশা ও মানসিক একাকীত্ব দূর করতে পারে। ব্যালকনিতে গাছ লাগানো ও তার যত্ন নেওয়া কোনো শখমাত্র নয়, এটি হালকা কিন্তু কার্যকর ব্যায়ামও।
⇨ শরীরচর্চার বিকল্প হিসেবে: টব সরানো, মাটি মেশানো, গাছ ছাঁটা বা জল দেওয়া, এই ছোট ছোট কাজগুলোয় হাত-পা ও কোমরের পেশি সচল থাকে, যা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।
বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘক্ষণ ডেস্কে বসে কাজ করেন, তাঁদের জন্য এটি রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার সহজ উপায়।
⇨ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা: বায়ু বিশুদ্ধ হওয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের মান উন্নত হয়। গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন শরীরে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়, ফলে কোষের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও ক্লান্তি কমে।
একটি মাঝারি আকারের ঘরের বাতাসও গাছপালা অনেকটা পরিষ্কার রাখতে পারে। অনেক ইনডোর প্ল্যান্ট, যেমন স্নেক প্ল্যান্ট, মানিপ্ল্যান্ট, অ্যালোভেরা বা পিস লিলি, বাতাসে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড, টক্সিন ও ধুলিকণা শোষণ করে বিশুদ্ধ বাতাস ছড়ায়। এছাড়া, গাছ বাতাসের আর্দ্রতা বজায় রাখে যা শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের জন্য উপকারী। গ্রীষ্মকালে গাছের পাতাগুলি তাপ শোষণ করে এবং বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আশপাশের তাপমাত্রা ২–৩ ডিগ্রি পর্যন্ত কমাতে সক্ষম।
শহরের ফ্ল্যাটে জায়গা স্বল্পতা কোনো বাধা নয়। সামান্য যত্নে বারান্দা বা জানালার ধারে তৈরি হতে পারে এক ক্ষুদ্র সবুজ বাগান। গাছের ধরন নির্বাচন-
◑ ফুলের গাছ: জবা, গাঁদা, বেলি, গোলাপ যা শুধু রঙ নয়, সুগন্ধও দেয়।
◑ ঔষধি গাছ: তুলসী, অ্যালোভেরা, পুদিনা যা ঘরোয়া যত্নে উপকারী।
◑ খাবারযোগ্য গাছ: ধনেপাতা, টমেটো, মরিচ বা পালং শাক যা বারান্দাতেই সহজে জন্মানো যায়।
◑ আলো ও স্থান: যেসব গাছ সূর্যের আলো চায়, যেমন তুলসী বা টমেটো, তাদের দক্ষিণমুখী বারান্দায় রাখা ভালো। ছায়াপ্রিয় গাছ যেমন পিস লিলি, স্নেক প্ল্যান্ট বা মানিপ্ল্যান্ট অল্প আলোতেও টিকে থাকে।
◑ মাটি ও যত্ন: হালকা দোআঁশ মাটিতে জৈব সার ব্যবহার করা যেতে পারে। সপ্তাহে ২–৩ দিন নিয়মিত পানি দেওয়া ও মৃতপাতা পরিষ্কার রাখলে গাছ থাকে সতেজ।
গাছের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেবল বেঁচে থাকার নয়, এটি এক ধরনের আবেগীয় বন্ধন।
যখন কেউ নিজের হাতে একটি টব সাজায়, প্রতিদিন পানি দেয়, নতুন পাতা গজাতে দেখে, তখন মস্তিষ্কে "achievement satisfaction" তৈরি হয়। এটি আত্মসম্মান ও আত্মতৃপ্তি বাড়ায়, মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখে। গাছের যত্ন নিতে গিয়ে মানুষ শেখে ধৈর্য, নিয়মিততা ও যত্নের মানে যা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শুধু মানসিক বা শারীরিক নয়, গাছপালা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি ছোট বারান্দা বাগান বছরে প্রায় ১০–১৫ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা পরিবেশ দূষণ কমাতে কার্যকর। এই উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
ব্যস্ত জীবনে সময়ের সংকট থাকলেও, একটি সবুজ বারান্দা কেবল বিলাসিতা নয়, এটি এখন একান্ত প্রয়োজন। গাছ আমাদের শেখায়, জীবনকে একটু ধীরে, একটু সচেতনভাবে উপভোগ করতে।ব্যালকনির সেই ছোট্ট গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু আসলে আমাদের মনেও এনে দেয় নবজীবনের আভা। সবুজে সময় দিন আপনার বারান্দাই হয়ে উঠুক মানসিক প্রশান্তির নতুন পৃথিবী।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।