বিচিত্র এক দেশ যেখানে নদী নেই, তবু উন্নয়নের জোয়ার থামে না কারণ জানলে অবাক হবেন!

বিচিত্র এক দেশ যেখানে নদী নেই, তবু উন্নয়নের জোয়ার থামে না কারণ জানলে অবাক হবেন!
ছবির ক্যাপশান, বিচিত্র এক দেশ যেখানে নদী নেই, তবু উন্নয়নের জোয়ার থামে না কারণ জানলে অবাক হবেন!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পৃথিবীতে যেখানে সভ্যতার জন্ম হয়েছে নদীর তীরে, সেখানে এক দেশ আছে যা প্রমাণ করেছে নদী না থাকলেও উন্নয়ন থেমে থাকে না। সেটি হলো সৌদি আরব-পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে নেই কোনো প্রাকৃতিক নদী, নেই বরফগলা জলধারা, নেই স্থায়ী হ্রদ তবুও দেশটি আজ প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এ যেন প্রকৃতির চরম পরীক্ষায় মানুষের মেধার বিজয়গাথা।

সৌদি আরবের ভৌগোলিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রস্থলে। দেশটির প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা মরুভূমি ও শুষ্ক প্রান্তর। এখানে বছরের অধিকাংশ সময় সূর্যের তীব্র তাপে মাটি ফেটে যায়, বৃষ্টিপাত হয় অতি সামান্য - গড়ে বছরে ৫০ থেকে ৯০ মিলিমিটার। এই কারণে এখানে কোনো স্থায়ী নদী নেই। বৃষ্টির সময় সাময়িকভাবে কিছু ওয়াদি (Wadi) বা শুকনো নদীখাত জলে পূর্ণ হয়, যা কয়েক ঘণ্টা বা দিনে শুকিয়ে যায়। অর্থাৎ, সৌদি আরবের জলবাহন সম্পূর্ণই মৌসুমি বৃষ্টিনির্ভর এবং অস্থায়ী। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতাই হয়ে উঠেছে সৌদি উন্নয়নের প্রেরণা।

নদী নেই, তবু সৌদি আরবে পানি সংকট নেই এ যেন প্রকৌশলের এক বিস্ময়। দেশটির প্রধান পানির উৎস তিনটি

◑ সমুদ্রের পানি থেকে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন (Desalination)

◑ ভূগর্ভস্থ পানির সংরক্ষণ ও উত্তোলন

◑ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুনঃব্যবহার

১. ডেস্যালিনেশন: সৌদি আরব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সমুদ্রের পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করে। দেশটির উপকূলজুড়ে স্থাপিত শতাধিক ডেস্যালিনেশন প্ল্যান্ট প্রতিদিন উৎপাদন করে কোটি কোটি গ্যালন বিশুদ্ধ পানি। বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত মোট ডেস্যালিনেটেড পানির ২০ শতাংশের বেশি সৌদি আরবেই উৎপাদিত হয়। এখানে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি Reverse Osmosis (RO) এবং Multi-Stage Flash (MSF) লবণাক্ত পানি থেকে শুধু লবণ নয়, খনিজ ও জীবাণুও অপসারণ করে নিরাপদ পানি তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া বর্তমানে সৌদি নাগরিকদের ৭০ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করছে।

২. ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনা: সৌদি মরুভূমির নিচে রয়েছে প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জলাধার বা aquifer, যা হাজার বছর আগে সঞ্চিত হয়েছিল। সরকার এখন সেই জলাধারগুলো থেকে পরিমিত পরিমাণে পানি তুলে ব্যবহার করছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও সংরক্ষণ থাকে।

৩. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: যেখানে বছরে কয়েকদিন বৃষ্টি হয়, সেই সামান্য বৃষ্টিকেও সৌদি আরব অপচয় হতে দেয় না। দেশজুড়ে তৈরি করা হয়েছে Rainwater Harvesting System, যা ছাদ, রাস্তা ও পাহাড়ি ঢাল থেকে পানি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ ট্যাঙ্কে জমায়, পরবর্তীতে তা পরিশোধন করে পুনঃব্যবহার করা হয়।

নদী না থাকলেও সৌদি আরব গড়ে তুলেছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা।

ড্রিপ ইরিগেশন (Drip Irrigation), হাইড্রোপনিক্স (Hydroponics) ও কন্ট্রোলড গ্রিনহাউস প্রযুক্তির মাধ্যমে অল্প পানি ব্যবহার করে উৎপাদন করা হচ্ছে শাকসবজি, খেজুর, গম, এমনকি ফুলও। এই পদ্ধতিতে

⇨ পানির অপচয় কমে ৭০% পর্যন্ত,

⇨ ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ হয় এবং

⇨ জমি ব্যবহারের কার্যকারিতা বেড়ে যায় ৪০%।

আজ সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম বড় খেজুর রপ্তানিকারক দেশ, যা বিশ্ববাজারেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।

সৌদি আরবের উন্নয়নের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো শূন্য নদী, তবুও প্রযুক্তিনির্ভর নগরায়ণ।

রাজধানী রিয়াদ এখন বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল শহর।

জুবাইল ও ইয়ানবু—দুটি শিল্পনগরী, যা সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সমুদ্রের তীরে।আর ভবিষ্যতের শহর NEOM, যা সৌদি উন্নয়নের ভবিষ্যৎ প্রতীক।

NEOM Project বা "The Line" হচ্ছে এমন এক স্মার্ট সিটি, যেখানে থাকবে কোনো গাড়ি নেই, কোনো দূষণ নেই, এবং সবকিছু পরিচালিত হবে নবায়নযোগ্য শক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

এটি দেখাচ্ছে, কিভাবে একটি মরুভূমিও পরিবেশবান্ধব সভ্যতার মডেলে রূপ নিতে পারে।

জলের পাশাপাশি সৌদি আরব টেকসই শক্তিতেও বিপ্লব ঘটিয়েছে। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বড় সৌরশক্তি উৎপাদক। "সাকাকা সোলার প্রজেক্ট" (Sakaka Solar Project) থেকে উৎপাদিত শক্তি দেশের কয়েক লাখ ঘরবাড়িতে সরবরাহ করা হয়। এই শক্তি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে—

◑ পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টে,

◑ কৃষি সেচে,

◑ ও নগর ব্যবস্থাপনায়।

অর্থাৎ, সৌদি উন্নয়নের মূলভিত্তি হলো জল, শক্তি ও প্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহার।

প্রাকৃতিক ঘাটতি পূরণে সৌদি আরব যে পথে হেঁটেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণা। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে King Abdullah University of Science and Technology (KAUST)—জল, শক্তি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য গবেষণাকেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনেই এসেছে স্মার্ট পানি ব্যবস্থাপনা ও লবণাক্ত জল পরিশোধনের নতুন প্রযুক্তি, যা ভবিষ্যতে গোটা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। অবশ্য উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবেশগত চ্যালেঞ্জও দেখা দিচ্ছে। ডেস্যালিনেশন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন লবণাক্ত বর্জ্য (brine) সমুদ্রে ফেরত গেলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া মরুভূমির তাপমাত্রা বৃদ্ধিও নতুন জলসংকট তৈরি করতে পারে। তাই সৌদি সরকার এখন টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে

⇨ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জল উৎপাদন,

⇨ বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং

⇨ জলের কার্বন পদচিহ্ন (Water Carbon Footprint) হ্রাসের উদ্যোগ নিচ্ছে।

নদী, হ্রদ বা ঝর্ণা ছাড়াও যদি কোনো দেশ সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে,

তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে মানবজাতির অগ্রগতির প্রতীক। সৌদি আরব দেখিয়েছে

"প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা নয়, উদ্ভাবনই উন্নতির উৎস।" নদীহীন মরুভূমির বুকে গড়ে উঠেছে বিশ্বমানের শহর, প্রযুক্তি ও টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এ যেন মানব মেধার জয়গান যেখানে এক ফোঁটা পানি কেবল জীবন নয়, এক টুকরো সম্ভাবনার প্রতীক।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ