ঘরে বানান জাপানি ওমুরাইস, স্বাদের থালায় ইতিহাসের ছোঁয়া!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
জাপানের রান্নাঘর শুধু খাবার তৈরির জায়গা নয়, এটা এক শিল্পশালা, যেখানে প্রতিটি পদে মিশে থাকে সংস্কৃতি, নান্দনিকতা ও বিজ্ঞান। তার মধ্যেই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও হৃদয়ের কাছাকাছি একটি খাবার হলো ওমুরাইস (Omurice)। অমলেটের কোমল আবরণে মোড়া ভাজা ভাতের এক স্নিগ্ধ গল্প। এ যেন এক থালায় জাপানের ঐতিহ্য, পশ্চিমা প্রভাব, ঘরোয়া উষ্ণতা আর আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানের নিখুঁত মিলন।
ওমুরাইসের গল্প শুরু হয় ১৯০০ সালের দিকে জাপানের ওসাকা শহরে। সেই সময় পশ্চিমা রন্ধনশৈলীর প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল জাপানে। "ইয়োশোকু" নামে পরিচিত এক নতুন ধারা গড়ে ওঠে, যেখানে জাপানি শেফরা পশ্চিমা খাবারকে নিজেদের স্বাদ ও উপকরণে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে লাগলেন। ঠিক তখনই, ওসাকার এক জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় (নাম "রেনতাই-শোকুডো") এক শেফ এক কর্মীর জন্য বানিয়েছিলেন এমন এক খাবার, যাতে থাকল জাপানি ভাত, পশ্চিমা কেচাপ, আর তার ওপর হালকা অমলেট। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেই জন্ম নিল "ওমুরাইস", যা পরবর্তী এক শতাব্দীতে জাপানের প্রতিটি পরিবারের রান্নাঘরের অংশ হয়ে ওঠে।
ওমুরাইস আজ জাপানে একটি নস্টালজিয়ার প্রতীক! স্কুলের টিফিন থেকে শুরু করে ক্যাফে, এমনকি হাসপাতালের মেনুতেও এই পদটি পাওয়া যায়। এটিকে অনেক সময় বলা হয় "কামফোর্ট ফুড", যা মানসিক প্রশান্তি দেয়, বাড়ির অনুভূতি ফিরিয়ে আনে। জাপানের "ক্যাফে কালচার"-এ ওমুরাইসের আলাদা অবস্থান রয়েছে- ক্যাফে ওয়েটাররা অনেক সময় গ্রাহকের নাম বা 'হার্ট শেপ' কেচাপ দিয়ে প্লেটে আঁকেন, যা জাপানি পপ সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।
রেসিপি: সহজে নিখুঁত ওমুরাইস-
☞ সময় : প্রস্তুতি: ১০ মিনিট; রান্না: ২০ মিনিট; মোট: ৩০ মিনিট
☞ উপকরণ (২ জনের জন্য)
১। ভাত - ২ কাপ (একদিন আগের ঠান্ডা ভাত হলে ভালো)
২। ডিম - ৩–৪টি
৩। মুরগির মাংস (ছোট কুচি) - ½ কাপ
৪। পেঁয়াজ কুচি - ½ কাপ
৫। গাজর ও ক্যাপসিকাম কুচি - ½ কাপ
৬। মটরশুঁটি (ঐচ্ছিক) - ২ টেবিলচামচ
৭। টমেটো কেচাপ - ২ টেবিলচামচ
৮। সয়াসস - ১ টেবিলচামচ
৯। লবণ ও গোলমরিচ - স্বাদমতো
১০। বাটার বা তেল - ২ টেবিলচামচ
প্রস্তুত প্রনালী :
১/ রাইস বেস তৈরি-
একটি ফ্রাইপ্যানে বাটার গরম করে পেঁয়াজ, গাজর, ক্যাপসিকাম ও মুরগি হালকা বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। তারপর টমেটো সস, সয়াসস ও ভাত দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। ভাত যেন ঝরঝরে হয়, অতিরিক্ত স্যাঁতসেঁতে যেন না হয়।
২/ অমলেট তৈরি-
অন্য প্যানে ৩টি ডিম ফেটিয়ে লবণ দিন। হালকা আঁচে ঢেলে দিন, চারদিক জমে গেলে মাঝখানটা নরম রাখুন। ওমুরাইসের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো-বাইরে নরম ও ভেতরে ক্রিমি টেক্সচার।
৩/ পরিবেশন-
প্লেটে ভাজা ভাত রাখুন, তার ওপর ধীরে অমলেটটি ঢেলে দিন। ছুরি দিয়ে মাঝখান কেটে দিলে অমলেটের নরম অংশ ভাতের ওপর গড়িয়ে পড়বে। চাইলে ওপরে কেচাপ বা ডেমিগ্লাস সস ঢেলে পরিবেশন করুন।
ওমুরাইস এখন জাপানের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
☞ কোরিয়ান ওমুরাইস: এখানে ডিমের বদলে পাতলা স্ক্র্যাম্বল করা ডিমের শিট ব্যবহার হয়, আর সসে থাকে মসলাদার গুচুজাং।
☞ থাই ওমুরাইস: হালকা ঝাল, ফিশ সস ও তুলসীপাতা দিয়ে বানানো হয়।
☞ পশ্চিমা ফিউশন: ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক শেফ চিজ, বেকন বা মাশরুম যোগ করেন, যা দেয় রিচ টেক্সচার ও ফ্লেভার।
এইভাবে ওমুরাইস আজ এক গ্লোবাল খাবার যা প্রত্যেক সংস্কৃতিতে নিজের মতো করে নতুন রূপ নিচ্ছে।
মনোবিজ্ঞান বলছে, অমলেট ও ভাতের মতো 'সফট টেক্সচার' খাবার মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোন বাড়ায়, যা স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে। তাই অনেক জাপানি পরিবারে ওমুরাইস "বিরক্ত মন ভালো করার" খাবার হিসেবে পরিচিত।
রন্ধন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওমুরাইসের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হলো এর সাদাসিধে কিন্তু হৃদয়স্পর্শী স্বাদ। একইসঙ্গে এটি 'কমফোর্ট ফুড' ও 'আর্ট ফুড', দুটোরই সেরা উদাহরণ। একটি প্লেটে আপনি পেয়ে যান রঙ, গন্ধ, পুষ্টি ও আবেগ সবকিছুর মিশ্রণ।
ওমুরাইস কোনো বিলাসী খাবার নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। যেখানে জাপানের ঐতিহ্য, পশ্চিমের প্রভাব ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক পুষ্টিবোধ একসঙ্গে মিলেছে। এটি প্রমাণ করে যে, একটি খাবার শুধুমাত্র পেট ভরায় না, এটি ইতিহাস বহন করে, সংস্কৃতির গল্প বলে এবং মানুষের মনে শান্তির ছোঁয়া দেয়। ওমুরাইস, এক থালায় জাপানের স্বাদ, পশ্চিমের ছোঁয়া, আর মানবিকতার উষ্ণতা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।