নবজাতকের খুশির মাঝে মা'দের নিঃশব্দ মানসিক চাপ: পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সচেতনতা ও প্রতিকার

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
নবজাতককে কোলে নেওয়া প্রতিটি মা'দের জন্য আনন্দের মুহূর্ত। তবে এই আনন্দের সঙ্গে অনেক মা'ই মুখোমুখি হন একধরনের নীরব মানসিক চ্যালেঞ্জের, যা বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression) বা সন্তান জন্মের পর বিষণ্নতা। এটি সাধারণ মায়েদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা স্বাভাবিক মাতৃত্বের আনন্দকে ম্লান করে দিতে পারে। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সাধারণত সন্তানের জন্মের পর প্রথম ছয় সপ্তাহ থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেখা দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি শুধুমাত্র মন খারাপ নয়, বরং গম্ভীর মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক প্রভাব ফেলে।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে সাধারণ মায়েদের "বেবি ব্লুজ" থেকে আলাদা করা প্রয়োজন। যদিও বেবি ব্লুজে হালকা উদ্বেগ বা অল্প বিষণ্নতা কয়েকদিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে চলে যায়, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন দীর্ঘমেয়াদী এবং প্রভাবশালী।
সাধারণ লক্ষণগুলো:
☞ দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ বা মানসিক চাপ।
☞ সন্তানের প্রতি আগ্রহ বা ভালোবাসা কমে যাওয়া।
☞ অতিরিক্ত ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা বা বেশি ঘুমানো।
☞ নিজেকে অযোগ্য বা অপর্যাপ্ত মনে করা।
☞ খাবার বা ওজন পরিবর্তন।
☞ অতিরিক্ত চিন্তা, উৎকণ্ঠা বা আতঙ্ক।
☞ মাঝে মাঝে হঠাৎ রাগ বা কান্নার উদ্রেক।
যদি এই লক্ষণগুলো দুই সপ্তাহের বেশি থাকে, তবে তা গম্ভীর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের ইঙ্গিত হতে পারে।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের পেছনে শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক উভয় কারণ কাজ করে।
◑ হরমোনের পরিবর্তন: জন্মের পর ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের স্তর দ্রুত কমে যায়। এটি মস্তিষ্কের রসায়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে, যার ফলে মন খারাপ, উদ্বেগ বা অনিদ্রা দেখা দিতে পারে।
◑ মানসিক চাপ: সন্তান লালন-পালন, ঘুমের অভাব, পরিবার বা সমাজের চাপ এবং ব্যক্তিগত উদ্বেগ মানসিক চাপ বাড়ায়।
◑ জীবনধারার পরিবর্তন: নতুন দায়িত্ব ও স্বাধীনতার অভাবও বিষণ্নতাকে প্রগাঢ় করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু জন্মের পর প্রায় ১০–২০% মা এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।
প্রতিরক্ষা ও চিকিৎসা-
১. স্বীকৃতি ও সচেতনতা: প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া। মায়ের নিজস্ব অনুভূতিকে "অসাধারণ বা অপর্যাপ্ত" মনে না করে, এটি একটি সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বোঝা জরুরি।
২. মানসিক সহায়তা: পরিবার, বন্ধু বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউন্সেলিং ও থেরাপি অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত উপকার দেয়।
৩. চিকিৎসা ও মেডিকেল সহায়তা: গম্ভীর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে মনোবিদ্যা বা সাইকোলজিস্ট/সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মাতৃত্বের নিরাপত্তা ও শিশুর যত্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হয়।
৪. জীবনধারার পরিবর্তন ও স্ব-যত্ন:
⇨ পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম।
⇨ হালকা ব্যায়াম, যেমন হাঁটা বা যোগ।
⇨ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যা শরীর ও মস্তিষ্ককে শক্তি দেয়।
⇨ নিজেকে চাপের মধ্যে না ফেলা; ছোটো ছোটো কাজ বা সময়সীমা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
৫. সামাজিক সমর্থন: পরিবার ও বন্ধুদের সহায়ক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান লালন-পালনে সহযোগিতা, বোঝাপড়া এবং মানসিক সমর্থন মায়ের পুনর্জীবন ও মানসিক সুস্থতায় বড় ভূমিকা রাখে।
সচেতনতার গুরুত্ব:
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে অবহেলা করা মারাত্মক হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি মা ও শিশুর সম্পর্ক, শিশুর মানসিক বিকাশ এবং পারিবারিক শান্তি ব্যাহত করতে পারে। তাই শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মা হওয়ার আনন্দের সঙ্গে যে মানসিক চাপ আসতে পারে, তা লজ্জার বিষয় নয়। সচেতনতা, পরিবার ও সামাজিক সহায়তা, চিকিৎসা এবং নিজের যত্ন—এই চারটি উপাদান মিলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে জয়ের পথ সুগম করে। প্রতি মা, পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব হলো, নবজাতকের আনন্দের মাঝেও মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া, যাতে ঘর-পরিবার আবার হয় শান্ত, সুখী ও স্নেহময়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।