যে ধারণা ভেঙে দিতে হবে আজই মানসিক অসুস্থতা অপরাধ নয়, স্বাস্থ্য সমস্যা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশে 'মানসিক অসুস্থতা' কথাটি শুনলেই মানুষ নানা প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ হাসাহাসি করে, কেউ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকায়, আবার কেউ বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মানসিক অসুস্থতা এখানে এখনও লজ্জা ও ভয়ের এক বিশাল বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়। মনে করা হয়, মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া মানে অপরাধের ছায়া বহন করা। অনেকেই এমন ব্যক্তিকে 'পাগল' ভাবেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানসিক রোগ কোনো অপরাধ নয়। এটি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিষয়ও নয়। যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন শারীরিক রোগ জ্বর, সর্দি, টাইফয়েড বা ক্যান্সার মানসিক রোগও ঠিক তেমনই একটি চিকিৎসাযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা।
মানসিক অসুস্থতা হলো মনের অসুখ, যা মানুষের চিন্তা, আবেগ এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। এটি শরীরের রোগের মতোই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এবং চিকিৎসাযোগ্য। কোনো ব্যক্তির চিন্তা বা আচরণে এমন পরিবর্তন ঘটলে, যা তার দৈনন্দিন জীবন, সম্পর্ক এবং কাজকর্মকে ব্যাহত করে, তখন তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ ধরা হয়। এর মধ্যে পড়ে:
◑ ডিপ্রেশন: দীর্ঘদিনের তীব্র হতাশা, আগ্রহহীনতা, নিজেকে মূল্যহীন মনে করা।
◑ এংজাইটি ডিসঅর্ডার: অতিরিক্ত ভয়, উদ্বেগ বা প্যানিক অ্যাটাক।
◑ স্কিৎজোফ্রেনিয়া: ভুল বিশ্বাস, ভৌতিক অভিজ্ঞতা বা অস্বাভাবিক আচরণ।
◑ বাইপোলার ডিসঅর্ডার: মেজাজের চরম ওঠা-নামা।
◑ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (OCD): পুনরাবৃত্ত আচরণ বা চিন্তাভাবনা। মনের অসুখ শারীরিক এবং আবেগীয় দুইভাবে প্রভাব ফেলে। তাই উপেক্ষা করা বা লজ্জার বিষয় হিসেবে ধরা কোনো সমাধান নয়।
মানসিক অসুস্থতার কারণ:
☞ অতিরিক্ত মানসিক চাপ: কাজের চাপ, পরীক্ষা, সম্পর্কের সমস্যা।
☞ পরিবেশগত প্রভাব: পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক চাপ বা প্রতিকূল পরিস্থিতি।
☞ জীবনের ঘটনা: প্রিয়জনের মৃত্যু, দুর্ঘটনা, নির্যাতন বা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
☞ জিনগত ও জৈব রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা: মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা মানসিক রোগে অবদান রাখে।
উপসর্গ চিহ্নিত করা
বয়স্ক ও কিশোরদের মধ্যে সাধারণ উপসর্গ:
⇨ দীর্ঘমেয়াদী হতাশা বা মেজাজের ওঠা-নামা
⇨ অতিরিক্ত ভয়, দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ
⇨ সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
⇨ খাদ্য বা ঘুমের পরিবর্তন
⇨ ভুল বা অদ্ভুত বিশ্বাস
⇨ আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টা
শিশুদের ক্ষেত্রে,
⇨ পড়াশোনায় আকস্মিক ফলাফলের পরিবর্তন
⇨ অতিরিক্ত চাঞ্চল্য বা নিথর হয়ে যাওয়া
⇨ ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা
⇨ অতিরিক্ত রাগ বা হঠাৎ আচরণ পরিবর্তন
চিকিৎসা ও সহায়তা:
মানসিক অসুস্থতা চিকিৎসাযোগ্য। প্রথম ধাপ হলো নিজেকে মেনে নেওয়া এবং লজ্জার বোঝা ঝেড়ে ফেলা। তারপর:
◑ বিশ্বস্ত কারো সাথে আলোচনা করা।
◑ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নেওয়া।
◑ ওষুধ বা থেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
◑ সাইকোলজিস্টের সঙ্গে কাউন্সেলিং করা।
◑ আলোচনা এবং আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে।
◑ সঠিক চিকিৎসা রোগের তীব্রতা অনুযায়ী দেওয়া হয়। ওষুধ বা থেরাপি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইকোলজিস্ট দ্বারা সুপরিচালিত হওয়া জরুরি।
প্রচলিত ভুল ধারণা-
মানসিক রোগ মানে পাগল হওয়া। বাস্তবে, পাগল হওয়া মানে মনের সম্পূর্ণ ভারসাম্য হারানো মানসিক রোগ মানে মানসিক ভারসাম্য কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে।
ধর্ম মেনে চললে রোগ হবে না। মানসিক রোগ ধর্ম, জাতি বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না।
ভয় বা দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক, চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক ভয় আর মানসিক রোগের উদ্বেগের মধ্যে তীব্রতার পার্থক্য আছে।
প্রায় ১৬% মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত, তবে সঠিক চিকিৎসা পাননি। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বাজেট মাত্র ০.৫%, সরকারী হাসপাতাল একটিমাত্র (পাবনা, হেমায়েতপুর), শয্যা সংখ্যা মাত্র ৫০০। পরিবার ও সমাজের লজ্জা এবং ভয়জনিত আচরণের কারণে রোগীরা প্রায়ই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।
সমাধান:
◑ সচেতনতা বৃদ্ধি।
◑ রোগীদের প্রতি সহানুভূতি ও সহায়তা প্রদান।
◑ সমাজে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
মানসিক অসুস্থতা কোনও অপরাধ নয়, চিকিৎসাযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা। রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং পরিবারের সহযোগিতা অপরিহার্য। সমাজে ভুল ধারণা ভেঙে সঠিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। একটি সহায়ক পরিবেশ রোগীর পুনর্বাসন দ্রুত এবং ফলপ্রসূ করে। মনে রাখবেন, আপনিও বা আপনার প্রিয়জন কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তখন সহানুভূতিপূর্ণ পরিবেশ এবং চিকিৎসা সবচেয়ে বড় সহায়ক।আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।