বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফুল রঙ হারাচ্ছে প্রকৃতি, সংরক্ষণের জোর আহ্বান!

বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফুল রঙ হারাচ্ছে প্রকৃতি, সংরক্ষণের জোর আহ্বান!
ছবির ক্যাপশান, বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফুল রঙ হারাচ্ছে প্রকৃতি, সংরক্ষণের জোর আহ্বান!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশের প্রকৃতি একসময় ছিল বর্ণিল, সুবাসময় আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। গ্রামীণ পথের ধারে, বাড়ির আঙিনায় কিংবা নদীর তীরে ফোটতো নানান দেশি ফুল-চম্পা, শিউলি, বকুল, চাঁপা, নাগলিঙ্গম, গোলাপজাম ইত্যাদি। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই চেনা ফুলগুলোর অনেকেই আজ আমাদের অচেনা হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও পরিবেশ দূষণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক দেশি ফুল ও উদ্ভিদ প্রজাতি। সাম্প্রতিক "রেড লিস্ট অফ প্লান্টস অব বাংলাদেশ" (২০২৪) অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩,৮০০ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে অন্তত এক হাজার প্রজাতির অবস্থার মূল্যায়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে বহু ফুল ও ঔষধি উদ্ভিদ এখন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, কিছু ইতিমধ্যে দেশীয়ভাবে বিলুপ্ত।

দেশীয় ফুলের বিলুপ্তি শুধু প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে মানুষের অদূরদর্শিতা ও পরিবেশবিধ্বংসী আচরণ। ক্রমবর্ধমান শহর সম্প্রসারণের ফলে গাছপালা ও ফুলের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। গ্রামীণ অঞ্চলে আগের মতো আর বাড়ির আঙিনায় ফুলগাছ লাগানো হয় না। বদলে গেছে চাষের ধরণ, বেড়েছে কৃত্রিম ফুল ও বাগানসজ্জার প্রচলন।

এ ছাড়া বনাঞ্চলে বাণিজ্যিক কাঠ সংগ্রহ, পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপন, কীটনাশক ও শিল্পবর্জ্য মাটিতে মিশে যাওয়ায় বহু ফুলের প্রজাতি তাদের স্বাভাবিক পরিবেশ হারাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনও ফুলের জীবনচক্রে প্রভাব ফেলছে; অনেক ফুল যা একসময় নির্দিষ্ট মৌসুমে ফুটত, এখন সেগুলোর ফুল ফোটার সময় কিংবা স্থায়িত্ব বদলে গেছে।

বাংলাদেশের কয়েকটি অমূল্য দেশি ফুল এখন প্রায় বিলুপ্ত বা সীমিত অঞ্চলে টিকে আছে। যেমন, পাহাড়ি বনাঞ্চলে একসময় প্রচুর দেখা যেত 'ফিতা চাঁপা' (Magnolia griffithii),একটি সুগন্ধি ও বৃহৎ পাপড়ির ফুল। আজ সেটি দেশীয়ভাবে বিলুপ্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত। একইভাবে হারিয়ে গেছে 'গোলা অঞ্জন' (Memecylon ovatum) ও 'জিরিঙ্গা' (Archidendron jiringa) নামের বৃক্ষজাত ফুল, যেগুলো একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে দেখা যেত। সুন্দরবনের কিছু অঞ্চলে থাকা অর্কিড প্রজাতি যেমন Bulbophyllum roxburghii ও Bulbophyllum oblongum এখন গুরুতর বিপন্ন! এগুলো একসময় বনাঞ্চলের গাছের গায়ে পরজীবীভাবে বেড়ে উঠত। কিন্তু বননিধন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ ছাড়া 'চৌলমূগ্রা' (Hydnocarpus kurzii), যা একসময় ওষুধি গাছ হিসেবে বিখ্যাত ছিল, এখন দেশে কেবল হাতে গোনা কয়েকটি স্থানে টিকে আছে।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের স্থানীয় ফুলগুলোর জেনেটিক বৈচিত্র্যই বাংলাদেশের উদ্ভিদজগতের প্রকৃত সম্পদ। এরকম বৈচিত্র্য হারিয়ে গেলে শুধু ফুলের সৌন্দর্য নয়, পুরো বাস্তুসংস্থানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক দেশি ফুল নির্দিষ্ট পোকা, মৌমাছি বা পাখির পরাগায়নের ওপর নির্ভরশীল। সেই ফুল না থাকলে সেই প্রাণীরাও হারিয়ে যেতে থাকে। এছাড়া, অনেক দেশীয় ফুল ও গাছ প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদিক ও ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এগুলো বিলুপ্ত হলে দেশের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতিরও বড় ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশ সরকার ও পরিবেশবিদরা এখন এই বিলুপ্তির প্রবণতা ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত "রেড লিস্ট" প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমবার দেশের উদ্ভিদের বিপন্নতার পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া বন অধিদপ্তর, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকরা টিস্যু কালচার ও বীজ সংরক্ষণের মাধ্যমে বিপন্ন ফুলগুলোর পুনর্জীবন ঘটানোর চেষ্টা করছে। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ইতিমধ্যেই ২০০টিরও বেশি বিরল প্রজাতির ফুল ও গাছ সংরক্ষণে সফল হয়েছে। তবে শুধু গবেষণা ও সংরক্ষণেই কাজ শেষ নয়। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, গ্রামীণ আঙিনায় দেশি ফুল লাগানোর উদ্যোগ, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা বৃদ্ধিই হতে পারে টেকসই সংরক্ষণের মূল উপায়।

বিশ্বের অনেক দেশ এখন 'ফ্লোরাল রেস্টোরেশন প্রজেক্ট' হাতে নিয়েছে, যেখানে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় ফুল ও উদ্ভিদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে স্থানীয় আবাসস্থলে। বাংলাদেশেও একই ধরনের কার্যক্রম জরুরি। কারণ, দেশীয় ফুল শুধু প্রকৃতির অলঙ্কার নয়, এগুলো আমাদের সংস্কৃতি, উৎসব, সাহিত্য ও স্মৃতির অংশ। যদি এখনই সংরক্ষণের পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো শুধু বইয়ের পাতায় বা ছবিতে দেখবে এই ফুলগুলোকে। আর তাতে হারাবে শুধু এক একটি প্রজাতি নয়, হারাবে বাংলাদেশের প্রকৃতির এক টুকরো আত্মা।

দেশি ফুল সংরক্ষণ মানে কেবল একটি ফুল রক্ষা করা নয়, বরং জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও মানুষের মনের রঙ রক্ষা করা। সময় এসেছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে এসে সেই ফুলের গন্ধ ফিরিয়ে আনার। প্রকৃতি একদিন নিজেই তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এখন, সেই ভারসাম্য নষ্ট না করা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ