চার্জিং কেবলের বিদায়ঘণ্টা,এবার বাতাসেই মিলবে বিদ্যুৎ!
 
                                        
                                    - Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একসময় বিদ্যুৎ মানে ছিল তার, প্লাগ ও জটলা। কিন্তু আজ বিজ্ঞানীরা এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন যেখানে কোনো তার ছাড়াই ডিভাইস চার্জ দেওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তির নাম ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সফার (Wireless Power Transfer বা WPT)। যেভাবে ইন্টারনেট এখন "ওয়্যারলেস" হয়েছে, তেমনি বিদ্যুৎ সরবরাহও আজ ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে "অদৃশ্য সংযোগে" নির্ভর। এটি শুধু সুবিধার জন্য নয়, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ এবং ভবিষ্যৎ শক্তিনীতির এক বিপ্লবী দিকও বটে।
কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি?
ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সফার মূলত তড়িৎচুম্বকীয় (Electromagnetic) ইন্ডাকশন ও রেজোন্যান্স নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে।
⇨ ইন্ডাকটিভ কাপলিং (Inductive Coupling): এটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি, যেখানে দুটি কয়েল ব্যবহৃত হয়-একটি ট্রান্সমিটার (চার্জার) এবং অন্যটি রিসিভার (ডিভাইস)।
ট্রান্সমিটার কয়েলে কারেন্ট প্রবাহিত হলে তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা কাছের রিসিভার কয়েলে পৌঁছে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। যেমন, স্মার্টফোন বা স্মার্টওয়াচের চার্জিং প্যাডগুলো এই নীতিতেই কাজ করে।
⇨ রেজোন্যান্ট ইন্ডাকটিভ কাপলিং (Resonant Inductive Coupling):
এখানে দুই কয়েল একই ফ্রিকোয়েন্সিতে রেজোনেট করে, ফলে দূরত্ব বেশি হলেও শক্তি স্থানান্তর সম্ভব হয়। এটি ইলেকট্রিক গাড়ি বা বড় ডিভাইস চার্জিংয়ে ব্যবহার হচ্ছে।
⇨ রেডিও ওয়েভ বা মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সফার: বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন যেখানে রেডিও ওয়েভ বা লেজার রশ্মির মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাঠানো যাবে দূরত্বে।
ভবিষ্যতে ড্রোন বা স্যাটেলাইটকেও এভাবে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি দেওয়া সম্ভব হবে।
ওয়্যারলেস পাওয়ারের ধারণা নতুন নয়। নিখোঁজ বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই "Tesla Coil" এর মাধ্যমে বাতাসে বিদ্যুৎ পাঠানোর পরীক্ষা চালান। যদিও তাঁর সেই ধারণা তৎকালীন সময়ে বাস্তবায়িত হয়নি, আজ সেই স্বপ্নই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফিরে এসেছে বাস্তবে।
আজ আমরা যে স্মার্টফোন বা ইয়ারবাড ব্যবহার করি, তার বেশিরভাগেই Qi Standard নামের একক ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তি যুক্ত। এর মাধ্যমে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের ব্যবধানে শক্তি স্থানান্তর করা যায় নিরাপদে। অন্যদিকে, গবেষকরা এখন কাজ করছেন—
ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য রাস্তা এমবেডেড চার্জিং সিস্টেমে, স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্সে তারবিহীন পাওয়ার নেটওয়ার্কে, এমনকি ইমপ্লান্টেবল মেডিকেল ডিভাইস (যেমন: হার্ট পেসমেকার)-এ, যাতে শরীরের ভেতরেও তার ছাড়াই শক্তি সরবরাহ করা যায়।
সুবিধা:
ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সফারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ব্যবহারিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা।
⇨ কেবলবিহীন চার্জিং, তাই তার ছেঁড়া বা স্পার্কের ঝুঁকি নেই
⇨ কম রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট বা সেন্সরে
⇨ পরিবেশবান্ধব, কেবল উৎপাদন ও বর্জ্য কমে যায়
⇨ ভবিষ্যতে "কেবল-ফ্রি রুম", যেখানে ঘরের মধ্যেই সব ডিভাইস চার্জ হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে
সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ:
প্রযুক্তির প্রতিটি সুবিধার সঙ্গে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জও থাকে।
⇨ দূরত্ব যত বাড়ে, কার্যকারিতা তত কমে যায়
⇨ শক্তি স্থানান্তরের ক্ষতি বেশি (Efficiency ৬০–৮০% পর্যন্ত সীমিত)
⇨ উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা চলছে
⇨ মানসম্পন্ন ডিভাইস ও চার্জারের দাম এখনও তুলনামূলক বেশি
বিজ্ঞানীরা এখন কাজ করছেন- উন্নত রেজোন্যান্স প্রযুক্তি, স্মার্ট সেন্সিং, ও লো-লস ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে।
আগামী দশকে ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সফার শুধু গ্যাজেট নয়, পুরো শক্তি অবকাঠামো বদলে দেবে। বাড়ির ছাদে সৌরপ্যানেলে উৎপাদিত শক্তি ওয়্যারলেসভাবে ঘরের প্রতিটি যন্ত্রে পৌঁছাবে; ইলেকট্রিক গাড়ি থামানো ছাড়াই রাস্তা থেকে চার্জ নেবে; এমনকি স্যাটেলাইট থেকে মাইক্রোওয়েভে পাঠানো শক্তি পৃথিবীর বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাবে। এই দৃশ্যগুলো আর কল্পনা নয়, পরীক্ষাগারে ইতিমধ্যেই সফলভাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সফার হলো আধুনিক সভ্যতার "অদৃশ্য শক্তির বিপ্লব", যেখানে বিদ্যুৎ চলবে বাতাসে, সংযোগ থাকবে চোখে দেখা ছাড়াই। এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন শক্তির ব্যবহার সহজ করছে, তেমনি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতেরও পথ দেখাচ্ছে। বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আরামদায়ক পরিবর্তনটি আসবে একটি "অদৃশ্য কেবলের" হাত ধরে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।
 
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    